ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ পৌষ ১৪৩১, ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

চব্বিশেও রাহুর সংকট কাটেনি বিশ্বের

মিরকান মিশুক, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
চব্বিশেও রাহুর সংকট কাটেনি বিশ্বের দখলদার ইসরায়েলের হামলায় গাজায় তৈরি হয়েছে মানবিক সংকট।

ঢাকা: নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল। আগের কিছু বছরের মতো এ বছরটিও ঘুরেছে বৈশ্বিক সংঘাত এবং মানবিক সংকটের আবর্তে।

বিশ্বের একাধিক অঞ্চলে এখনো মারাত্মক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। চব্বিশের এই রাহু নতুন বছরে কাটবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

বিদায়ী বছরের আলোচিত সংঘাত-সংকট নিয়ে পড়ুন সালতামামি।

ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেনে যুদ্ধ ২০২৪ সালে বৈশ্বিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই থেকে গেছে। এই যুদ্ধে শুধু ২০২৪ সালেই ৬৭ হাজার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই সংঘাত ইউক্রেন এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং মানবিক সংকট তৈরি করেই চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ সমীকরণও বদলে যাবে। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি একদিনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। ইউক্রেন এবং ইউরোপের অনেকেই ধারণা করছেন, এর মানে হবে পুতিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

মস্কো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা উল্লেখযোগ্য ভূখণ্ড দখল করছে। বড় প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরলে রাশিয়া-ইউক্রেন, কার ঘরে কী অর্জন যাবে!

গাজায় বিপর্যস্ত মানবতা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সেখানে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। সেখানে মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপর্যস্ত। নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী-শিশু। এই সংঘাতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুতরা খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে ভুগছে। গাজার সহিংসতা মধ্যপ্রাচ্যেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে, যা একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংকটের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

ইসরায়েল গাজার পাশাপাশি এ বছর লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরান ও তার ইয়েমেনি-ইরাকি মিত্রদের সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। যদিও হিজবুল্লাহ সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছে তারা। তবে গাজায় হচ্ছে হচ্ছে করেও এখনো তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সংকট থেকে গভীর সংকটে সিরিয়া  

আরব বসন্তের ঢেউ লেগে সিরিয়ার বিশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় ২০১১ সালে। আসাদ পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যেটা দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। একাধিক পক্ষ ও বহিঃশক্তির অংশগ্রহণে সিরিয়ার সংঘাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নেয়। বাশার আল-আসাদের সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে, যা সংঘাতকে আরও উসকে দেয়।

আসাদ আলাওয়ি শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, ফলে তার দমননীতি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি উত্তেজনা তৈরি করে। এই সংকটে ইরান ও রাশিয়া আসাদের সরকারকে সমর্থন দিলেও সৌদি আরব, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।

দেশটিতে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ইসলামিক স্টেট-আইএসসহ চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান সংঘাতকে আরও জটিল করে তোলে।

রাশিয়া ইউক্রেনে মনোযোগী হয়ে পড়লে এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সিরিয়ার পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। এই সময়টাতেই বিদ্রোহীরা বাশার আল-আসাদকে উৎখাতে সক্ষম হয় এবং তারাই এখন দেশটি পরিচালনার চেষ্টা করছে। তবে ক্ষমতা নেওয়া এইচটিএসকে নিয়ে অন্য পক্ষগুলোর অস্বস্তি এবং গোলান সীমান্তে ইসরায়েলি দখলদারদের হানা নতুন সংকটের আভাস দিচ্ছে।

খাদের কিনারে সুদান

আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ সুদানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংঘাত ক্রমে জটিল রূপ ধারণ করছে, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জাতিগত সহিংসতা এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে।
 
সুদানে সরকারের সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) এবং প্যারামিলিটারি র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) মধ্যে সংঘর্ষের কারণে একটি গুরুতর মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এই সংকটে ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে, যার ফলে প্রায় দুই কোটি শিশু স্কুল যাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এসএএফ ও আরএসএফের সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সংঘর্ষ রাজধানী খার্তুমসহ বেশ কয়েকটি বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সংঘর্ষের ফলে হাসপাতাল, স্কুল এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) সুদান সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিলেও স্থায়ী সমাধান এখনো অধরা। আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম যুদ্ধের কারণে প্রায় অচল।

কোণঠাসা মিয়ানমারের জান্তা

২০২১ সালে গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার যেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জাতিগত সংঘাত এবং সামরিক শাসনের কারণে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটছে।

অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনডিএল) বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উসকে দেয়। এক পর্যায়ে দেশটির নানা অঞ্চলে জাতিগত সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।

মিয়ানমারে ১৩৫টিরও বেশি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, যেমন কাচিন, শান, রাখাইন এবং কারেন, দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করে আসছে। এই রকম কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে গঠন করেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স। যারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সাম্প্রতিক লড়াইয়ে জান্তা একের পর এক অঞ্চল হারিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যও সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কাছে হারিয়েছে জান্তা বাহিনী।  

কঙ্গো সংকট

আফ্রিকার আরেক দারিদ্র্যপীড়িত দেশ কঙ্গো (ডিআরসি)। সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু হওয়া এখানকার সংকটের দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় পরিণত হচ্ছে।

২০২২ থেকে এম২৩ গোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলে সক্রিয়ভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। বর্তমানে এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলে তাদের আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে আড়াই কোটি মানুষের মানবিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

গোষ্ঠীটি দাবি করছে, তারা সংখ্যালঘু তুতসি জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য লড়াই করছে। তবে তাদের কর্মকাণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, মোজাম্বিক, নাইজার, সোমালিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক ও মানবাধিকার সংকট ২০২৪ সালেও কাটেনি। এসব দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার শিকার হচ্ছে। সংকট গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সহায়তার প্রয়োজন বাড়ছে। যার সমাধানে গৃহীত আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো প্রায় সময় অপ্রতুল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
এমএম/এইচএ/
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।