মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ভয়াবহ দাবানলে পুড়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এমন দুর্যোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন।
গত দুই দশক ধরে স্পেনের মাদ্রিদ, সৌদি আরবের রিয়াদ ও ভারতের লখনউসহ কয়েক ডজন শহর ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। কোনোটি শুষ্ক থেকে আর্দ্র হয়ে গেছে। কোনোটির ক্ষেত্রে উল্টোটি হয়েছে। গবেষকরা ১১২টি শহর বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ৯৫ শতাংশ শহরের জলবায়ু বদলে শুষ্কতা বা অতিবৃষ্টির দিকে গেছে।
জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের পরিণতি গুরুতর। পাকিস্তানের করাচী ও সুদানের খার্তুমের মতো অল্প পানির উৎস নিয়ে কষ্টে থাকা শহরগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউরোপ, আরব উপদ্বীপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঞ্চল শুষ্ক হয়ে উঠলেও, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শহরগুলোয় তীব্র বৃষ্টিপাত ঘটছে।
গবেষণায় মানবসৃষ্ট ভৌগোলিক উষ্ণায়নের ফলে তৈরি হওয়া তীব্র ব্যাঘাতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ৯০ শতাংশ জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী পানির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো। এটি পৃথিবীজুড়ে চার দশমিক ৪ বিলিয়নেরও বেশি শহরবাসী মানুষকে প্রভাবিত করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে খরা এবং বন্যা দুটোই বেড়ে যায়। উষ্ণ বায়ু আরও আর্দ্রতা শুষে নিয়ে শুষ্ক আবহাওয়াকে তীব্র করে তোলে এবং প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ডেকে আনে।
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাটেরিনা মাইকেলাইডস সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের জলবায়ু পরিবর্তন পরস্পরের থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন। তার সহ-গবেষক কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল সিঙ্গার বলেছেন, বেশিরভাগ এলাকা কোনো না কোনোভাবে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু ওই বদল সম্পর্কে সবসময় আগে থেকে পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে না।
এই দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিশাল চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর অনেক শহর এর মধ্যেই পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন এবং বন্যা মোকাবিলা নিয়ে বিপদে আছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং পুরানো অবকাঠামোগুলোকে আরও বিপদে ফেলছে। এমন সমস্যা বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের দেশগুলোয় তীব্র। সেসব স্থানে চরম আবহাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ছে।
জলবায়ু কশাঘাতের শিকার শহরগুলোর একটি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি। সেখানকার বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে চরম খরা এবং বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলা করছেন। পানির অভাব, ফসলহানি, গবাদি পশুর মৃত্যুতে সেখানকার মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে অতিবৃষ্টি এবং সর্বগ্রাসী বন্যা আর পানি দূষণে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে মাইকেলাইডস ব্যাখ্যা করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, জাকার্তা, ডালাস, বাগদাদ ও মেলবোর্নসহ পৃথিবীর ১৭টি শহর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ওইসব স্থানে আর্দ্রতা ও শুষ্ক সময়ের মধ্যেও চরমভাবে ওঠানামা করছে। মাদ্রিদ, রিয়াদ ও মিশরের রাজধানী কায়রোয় জলবায়ুর তীব্র পরিবর্তন রেকর্ড করা হয়েছে। লখনউ, কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা ও ইরানের রাজধানী তেহরানের মতো শহরগুলোয় আর্দ্রতার নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে।
গবেষণায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে। শহরগুলোয় জলবায়ু ঝুঁকি বাড়ছে। কিন্তু সেইসব স্থানের অভিযোজনের ক্ষমতা কম। ওই তালিকার শীর্ষে রয়েছে খার্তুম, পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ এবং জর্ডানের রাজধানী আম্মান। আরেকটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শহর পাকিস্তানের করাচীতে অতিবৃষ্টি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে। আশ্রয়হীন মানুষ অনেক দিন অনেক রাত বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে কাটিয়েছে।
যেসব শহরে জলবায়ুর বড় পরিবর্তন খুব একটা হয়নি, সেখানেও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব স্পষ্ট। লস অ্যাঞ্জেলেস, ফ্রান্সের প্যারিস, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন ও ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শুষ্ক হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ভারতের মুম্বাই, পাকিস্তানের লাহোর ও আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের মতো শহরগুলোয় আর্দ্রতা বাড়ছে।
এই ফলাফলগুলো জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল আইপিসিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ভৌগোলিক তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে গেলেও জলবায়ুর চরম পরিবর্তনকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। তাপপ্রবাহ, খরা এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে কয়েক দশমাংশ ডিগ্রি উষ্ণতা এবং আমাদের পরিচিত জীবনযাপনে ঝুঁকি বাড়াবে। এমনটি জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক সোনিয়া সেনেভিরাত্নে।
গবেষকরা ১৯৮৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জলবায়ু প্রবণতা বিশ্লেষণ করার জন্য স্ট্যান্ডার্ডাইজড প্রিসিপিটেশন ইভাপোট্রান্সপিরেশন ইনডেক্স ব্যবহার করেছিলেন। গত দুই দশকে যদি শহরগুলোয় কমপক্ষে ১২ মাস চরম বৃষ্টিময় বা শুষ্ক থাকে, এবং ১২ মাস উল্টো অবস্থা থাকে, তাহলে শহরগুলোর জলবায়ু বদলে যাচ্ছে বলে ধরা হয়। যেসব শহরে কমপক্ষে পাঁচ মাস অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং শুষ্ক আবহাওয়া ছিল। শহরগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে, এমনটি মনে করা হয়েছিল।
গবেষণায় জনসংখ্যার তথ্য প্রশাসনিক সীমানার পরিবর্তে জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচক ব্যবহার করে সামাজিক দুর্বলতা পরিমাপ করা হয়েছে। পানি এবং বর্জ্য অবকাঠামোর তথ্য ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গ্লোবাল ডেটাসেট থেকে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৫
এমএইচ/এমজে