ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

রাখাইনে স্বাধীনতার হাওয়া, রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

আন্তজার্তিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫১, মে ১৭, ২০২৫
রাখাইনে স্বাধীনতার হাওয়া, রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএএলএ)- এর গত এক বছরের সামরিক সফলতা বিস্ময়কর। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালেই রাখাইন কার্যত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে— যা ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে কোনো অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রথম সফলতা হতে যাচ্ছে।

এর আগে বার্মিস কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় ওয়া এবং কোকাং সশস্ত্র গোষ্ঠী দুটি তাদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।  

আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীকে প্রায় পুরো রাখাইন রাজ্য থেকে উৎখাত করেছে এবং সিত্ত ও কিয়কফিউর মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে অবরোধ সৃষ্টি করেছে।  

উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত রাখাইনজুড়ে আরাকান আর্মির দখল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা মাগওয়ে, বাগো এবং ইরাবতী ডেল্টায়ও তারা প্রবেশ করেছে। যদিও গোষ্ঠীটি ভবিষ্যতের জন্য ‘কনফেডারেশন’ ধারণার কথা বলছে, তাদের সামরিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ইঙ্গিত দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

তবে তাদের সামনে রয়েছে সামরিক নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে প্রশাসন গড়ে তোলা, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংবেদনশীল আন্তঃসম্প্রদায়িক সম্পর্ক পরিচালনা করা এবং চীন, ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার মত অনেক জটিল সব চ্যালেঞ্জ।

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সম্ভাব্য স্বাধীন শাসনে রোহিঙ্গাদের ভূমিকা ও অধিকার নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। যদিও আরাকান আর্মি ঘোষণা দিয়েছে তারা ‘আরাকানের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছে’। তবে তারা এখনো পরিষ্কারভাবে বলেনি রোহিঙ্গা, ম্রো, দৈংনেট, চিন, কামান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার কেমন হবে।

আরাকান আর্মি তাদের প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থায় সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে যুক্ত করেছে ঠিকই, তবে তাদের ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ও সমঅধিকারের বিষয়টি এখনো অজানা। এটি স্পষ্ট যে, নতুন কাঠামোতে যদি পূর্বের মিয়ানমার সেনা শাসনের বৈষম্য ও নিপীড়ন নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হবে ভয়াবহ।

এদিকে ইউএসএইড ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহায়তা কমানোর কারণে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের সংঘর্ষে পালিয়ে আসা আরও ৬০-৮০ হাজার রোহিঙ্গার বিষয়েও পরিকল্পনা জরুরি। জাতিসংঘ দূত ও মহাসচিবের সাম্প্রতিক কক্সবাজার সফর প্রতীকী গুরুত্ব রাখলেও বাস্তব অবস্থার উন্নয়নে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে না। একদিকে খাদ্য সহায়তা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশও সীমান্তবর্তী মানবিক সংকটের মুখোমুখি।

আরও জটিলতা তৈরি করছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা, যাদের মধ্যে অনেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করছে। আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্প্রতি সহিংসতা ও উত্তেজনা বাড়েছে, যা রাখাইনের মংডু থেকে বাংলাদেশের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা আপাতত প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। রাখাইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি নতুন, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি না এলে পরিস্থিতির কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

আরাকান আর্মি ও এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান-এর অবস্থান বর্তমান মিয়ানমারের সংঘাতে অন্য সব সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে আলাদা। কারণ, তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে প্রতিবেশী তিন শক্তিধর দেশ— চীন, ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও সমঝোতার ওপর।

রাখাইন রাজ্যে চীনের ১১টি প্রকল্পের মধ্যে ২টি পুরোপুরি এবং ৮টি আংশিক নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। এ অবস্থানে চীনের ওপর কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করতে পারে গোষ্ঠীটি, যাতে তারা মিয়ানমার জান্তা সরকারের ওপর বোমা হামলা বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানায়, ‘আরাকান পিপলস রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট’ বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ফলে ধারণা করা যাচ্ছে, চীন ও আরাকানের বিদ্রোহীরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

রাখাইনে বাস্তুচ্যুত হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য ভারত ও মিয়ানমার সরকারের যৌথ মৈত্রী প্রকল্পে নির্মিত নতুন বাড়ি

ভারতের সাথে আরাকান আর্মির আলোচনা চললেও তার বিস্তারিত এখনও পরিষ্কার নয়। অপরদিকে, বাংলাদেশ এই সংকটে আরও নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রচেষ্টায় আরাকান আর্মিসহ চিন ব্রাদারহুডের মতো গোষ্ঠীগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বও চাপ না দিয়ে বরং বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে রাখাইনে সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে।

অঞ্চলটিতে গত এক দশকে ‘সামাজিক সম্প্রীতি’ ও ‘শান্তি মধ্যস্থতা’ নামে বহু প্রকল্পে কোটি কোটি ডলার ব্যয় হলেও বাস্তবে ফলাফল শূন্য। আরাকান আর্মি শুরু থেকেই ‘ন্যাশনওয়াইড সিজফায়ার অ্যাগ্রিমেন্ট’ থেকে দূরে থেকেছে এবং পশ্চিমা এনজিওগুলোকে এড়িয়ে চলেছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব রাখাইনে কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না বরং জীবন রক্ষাকারী সহায়তা বাজেট কাটছাঁট করছে।

২০১৯ সালের বুথিডাউংয়ে স্বাধীনতা দিবসের আক্রমণের আগে পর্যন্ত আরাকান আর্মি-কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু ছয় বছরের ব্যবধানে তারা বিশাল এলাকা দখল করেছে, শহরভিত্তিক ও গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে বহু সামরিক ঘাঁটি দখল ও হাজার হাজার সৈন্য হত্যা বা আটক করেছে তারা। এ থেকে স্পষ্ট আরাকান আর্মি স্তরভিত্তিক পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের জন্য সুসংগঠিত রোডম্যাপ তৈরি করেছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাখাইনের বাস্তবতা হলো— মিয়ানমার সামরিক সরকার সেখানে আর সার্বভৌম শক্তি নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে এখন আরাকান আর্মিকে একটি বাস্তব শক্তি হিসেবে স্বীকার করে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় এসেছে। নয়তো রাখাইন অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা কল্পনাবিলাস হয়েই থেকে যাবে।

মিয়ানমার ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ‘ইরাবতী’তে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংঘাত ও মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কাজ করা স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড স্কট ম্যাথিসনের লেখার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ