ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ জুন ২০২৫, ২২ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘিরে পাকিস্তানে উদ্বেগ, নিরাপত্তা শঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০৮, জুন ১৮, ২০২৫
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘিরে পাকিস্তানে উদ্বেগ, নিরাপত্তা শঙ্কা ১৫ জুন ইসরায়েলের হাইফায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থল থেকে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে

ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের মাঝে কূটনৈতিক চাপ সামাল দিতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। ইসলামাবাদ উদ্বিগ্ন, কারণ এই উত্তেজনা দেশটির নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে বেলুচিস্তান প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও কৌশলগত পরিস্থিতি নিয়ে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান ও ইরান একে অপরের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়— সীমিত সময়ের সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে।

তবে ১৭ মাস পর, যখন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় এবং একাধিক ইরানি জেনারেল ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে, তখন পাকিস্তান দ্রুত ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়।

ইসলামাবাদ ইসরায়েলি হামলাকে ইরানের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে এবং একে ‘সুস্পষ্ট উসকানি’ বলে আখ্যায়িত করে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৩ জুন এক বিবৃতিতে জানায়, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের উচিত আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা করা, এই আগ্রাসন তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা এবং হামলাকারীকে জবাবদিহির আওতায় আনা”।

ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা ষষ্ঠ দিনে পা রাখায় ইসলামাবাদে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের জটিল সম্পর্ক এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রভাব পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসার আশঙ্কা থেকেই এই উদ্বেগ।

তাৎক্ষণিক প্রভাব
এই সংঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ইসরায়েলের হামলায় ইতোমধ্যে ২২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। পাল্টা জবাবে ইরান শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েল অভিমুখে, যাতে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে এবং ব্যাপক সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বেলুচিস্তান প্রদেশ দিয়ে ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের ৯০৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ইরানের প্রতি সমর্থন জানালেও ১৫ জুন থেকে বেলুচিস্তানের পাঁচটি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান।

সম্প্রতি ৫০০ জনের বেশি পাকিস্তানি নাগরিক, মূলত তীর্থযাত্রী ও ছাত্র ইরান থেকে ফিরেছেন।

তাফতান অঞ্চলের সহকারী কমিশনার নাঈম আহমেদ আল জাজিরাকে বলেন, “সোমবার ৪৫ জন ছাত্র, যারা ইরানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছিলেন, তারা পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া প্রায় ৫০০ জন তীর্থযাত্রী তাফতান সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরেছেন। ”

তাফতান বেলুচিস্তানের চাঘি জেলায় অবস্থিত, যেখানে পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে তার পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল। এই এলাকা রেকো ডিক ও সাঁইদক খনি দিয়েও পরিচিত, যেখানে সোনা ও তামা পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের সীমান্ত বন্ধের মূল কারণ হচ্ছে বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগ, যা ইরানের সঙ্গে এর সম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত।

জটিল ইতিহাস
পাকিস্তান ও ইরান উভয়েই একে অপরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লালন-পালনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে, যারা সীমান্ত পার হয়ে হামলা চালায়।

সবশেষ বড় উত্তেজনা দেখা দেয় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। সেই সময় ইরান বেলুচিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে দাবি করে যে, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী জইশ আল আদলকে লক্ষ্য করেছে।

২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয় এবং ইরানের অভ্যন্তরে বেলুচ বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে হামলা চালায় বলে দাবি করে।

এই উত্তেজনার পর দুই দেশ মীমাংসার পথে হাঁটে। এমনকি মে মাসে পাকিস্তান ও ভারতের সীমিত সামরিক উত্তেজনার সময় ইরান নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে।

১৩ জুন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সংসদে বলেন, ইসলামাবাদ ইরানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতার ভূমিকা রাখতে চায়।

তিনি বলেন, “ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (আব্বাস আরাগসি) আমাকে বলেছেন, যদি ইসরায়েল আর কোনো হামলা না করে, তাহলে তারা আবার আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত। আমরা এই বার্তাটি অন্যান্য দেশকে জানিয়েছি, এখনও সময় আছে ইসরায়েলকে থামানোর ও ইরানকে আলোচনায় ফেরানোর। ”

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তালাল চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেন, “আমরা আমাদের ভূমিকা পালন করছি, কিন্তু বিশ্বেরও দায়িত্ব আছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক—এই যুদ্ধগুলো তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে, এমনকি আইএসআইএসের উত্থান ঘটায়। আমরা চাই না, সেটা আবার ঘটুক। ”

টাফ্টস ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফাহদ হুমায়ুন বলেন, পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে শান্তি স্থাপনের যেকোনো প্রচেষ্টায় সফল হতে পারে এই কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনও অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ নয় বরং আলোচনার পক্ষে মত দিচ্ছে।

তবে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের গবেষক উমের করিম বলেন, “পাকিস্তানের এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য বা সদিচ্ছা খুব সীমিত, তবে তারা অবশ্যই চায় যেন এই সংঘাত দ্রুত শেষ হয়”।


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ মে মাসে তেহরান সফর করেন। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি (ডানে) ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের (বামে) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বেলুচিস্তান ও নিরাপত্তা সংশয়
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো বেলুচিস্তানে সম্ভাব্য প্রভাব। বিশাল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও এই প্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। সোনা, তামা, তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চলটি পাকিস্তানের আয়তনে সবচেয়ে বড়, কিন্তু জনসংখ্যায় সবচেয়ে ছোট, প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ।

১৯৪৭ সালের পর অন্তত পাঁচবার সেখানে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। বিদ্রোহীরা স্থানীয় সম্পদের বৃহত্তর অংশ বা স্বাধীনতা দাবি করেছে, যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সেনা অভিযানের মুখে পড়েছে তারা।

এই প্রদেশে অবস্থিত কৌশলগত গওয়াদর বন্দর, যা ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, সরকার স্থানীয় উন্নয়ন উপেক্ষা করে কেবল সম্পদ শোষণ করছে। পাকিস্তানের ও ইরানের উভয় পাশেই সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো বিশেষত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) স্বাধীনতার লক্ষ্যে লড়াই করছে।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক আবদুল বাসিত বলেন, “যদি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তবে এসব সংগঠনের সদস্যরা, যারা ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকেন, তারা পাকিস্তানে ঢুকে নিরাপত্তা চাইতে পারেন। তাই সীমান্ত বন্ধ করে পাকিস্তান আগেভাগেই চেষ্টা করছে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে। ”

আফগানিস্তানের পুনরাবৃত্তির ভয়
সোভিয়েত আক্রমণের পর ১৯৭৯ সাল থেকে পাকিস্তানে আফগান উদ্বাস্তু প্রবেশ করতে থাকে। ২০২১ সালে তালেবান কাবুল দখলের পর আবার উদ্বাস্তু ঢুকে পড়ে। এক সময় প্রায় ৪০ লাখ আফগান পাকিস্তানে ছিল।

২০২৩ সালে পাকিস্তান তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে সরকার বলছে, প্রায় ১০ লাখ উদ্বাস্তু ফেরত পাঠানো হয়েছে। পাকিস্তান বলছে, আফগানিস্তানে থাকা গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানে সহিংসতা বাড়াচ্ছে।

আবদুল বাসিত বলেন, “ইরানের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকায় উদ্বাস্তুর ঢল ঠেকাতে পাকিস্তান আগেভাগেই সীমান্ত বন্ধ করেছে“।

ইসরায়েলের আকাশ-নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা
পাকিস্তানের উদ্বেগ শুধু বেলুচ বিদ্রোহী বা উদ্বাস্তু নিয়েই নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, তাদের বিমানবাহিনী এখন তেহরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। পাকিস্তান, যে দেশটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না ও শত্রু মনে করে, চায় না এই নিয়ন্ত্রণ ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হোক।

গবেষক উমের করিম বলেন, “পাকিস্তান চায় না ইসরায়েল ইরানের আকাশে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক। এতে পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। ”

অতীত থেকে ভিন্ন অবস্থান
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানউল্লাহ টিপু মেহসুদ বলেন, অতীতে পাকিস্তান আঞ্চলিক সংঘাতে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকেছে, বিশেষত আফগানিস্তানে। তবে এবার তাদের অবস্থান ভিন্ন হতে পারে।

সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও পাকিস্তানে প্রায় ১৫ শতাংশ শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে।

শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, বলেন টিপু মেহসুদ।

সূত্র: কাতার ভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরার ইসলামাবাদ করেসপন্ডেন্ট আবিদ হুসেইনের প্রতিবেদন অবলম্বনে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।