ইসরায়েল-ইরান সংঘাত দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়াতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার (২১ জনু) সন্ধ্যায় ট্রুথ সোশ্যালে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ফোর্দো, ইসফাহান এবং নাতানজ স্থাপনাগুলোকে ‘সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস’ করা হয়েছে।
তবে ইরানের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের এই দাবিকে ছোট করে দেখাচ্ছেন। একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, হামলাটি ছিল ‘অগভীর’ এবং ফোর্দোতে তেমন কোনো গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এই হামলার চিরস্থায়ী পরিণতি হবে। যদিও ট্রাম্প পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইরানের যেকোনো প্রতিশোধের জবাবে শক্তি প্রয়োগ করা হবে।
নিচে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্রবিন্দু এই তিনটি স্থাপনা সম্পর্কে যা জানা গেছে তা তুলে ধরা হলো:
নাতানজ
নাতানজ পারমাণবিক কমপ্লেক্সটি রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত এবং এটি ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র বলে ধরা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, এখানে সেন্ট্রিফিউজ তৈরি ও সংযোজন করা হয়, যা ইউরেনিয়ামকে পারমাণবিক জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য অপরিহার্য।
নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ (এনটিআই) অনুসারে, এই স্থাপনায় মাটির ওপর ছয়টি ভবন এবং ভূগর্ভস্থ তিনটি কাঠামো রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ৫০,০০০ পর্যন্ত সেন্ট্রিফিউজ ধারণ করতে পারে।
ইসরায়েলের প্রাথমিক হামলায় এই স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হয়। স্যাটেলাইট চিত্র ও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নাতানজের পাইলট ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টের ভূমিপৃষ্ঠের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই বিশাল স্থাপনা ২০০৩ সাল থেকে চালু ছিল এবং এখানে ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হচ্ছিল বলে জানায় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। উল্লেখ্য, অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম সাধারণত ৯০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ করা হয়।
আগের হামলায় ভূগর্ভস্থ স্তরে বিদ্যুৎ সরবরাহও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, যেখানে সেন্ট্রিফিউজগুলো থাকে। যেহেতু স্থাপনাটির বড় অংশ মাটির নিচে, তাই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিল নিচের যন্ত্রপাতিতে প্রভাব ফেলার।
ফোর্দো
এই গোপন ও সুরক্ষিত স্থাপনাটি কুমে শহরের কাছে এবং এটি পাহাড়ঘেরা এলাকায় গভীরভাবে মাটির নিচে নির্মিত।
এই কেন্দ্রটি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, তার অনেকটাই ইসরায়েলি গোয়েন্দারা কয়েক বছর আগে ইরানি গোপন দলিল চুরি করে পেয়েছে।
এর মূল হলগুলো ভূমি থেকে আনুমানিক ৮০–৯০ মিটার নিচে, যা বিমান হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করাকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। আগে থেকেই জানা, এই গভীরতায় আঘাত হানার মতো বোমা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সেই বোমাগুলোও যথেষ্ট নাও হতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি (আইএসআইএস) বলছে, ইরান তার ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বর্তমান মজুত থেকে তিন সপ্তাহে ২৩৩ কেজি অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম তৈরি করতে পারে, যা ৯টি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট।
আইএইএ-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ফোর্দোতেও ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বর্তমানে ২,৭০০ সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে।
ইস্পাহান
মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরটি দেশটির সবচেয়ে বড় পারমাণবিক গবেষণা কমপ্লেক্সের আবাসস্থল।
চীনের সহায়তায় এটি নির্মিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে চালু হয় বলে জানায় এনটিআই। সংস্থাটির মতে, এখানে প্রায় ৩,০০০ বিজ্ঞানী কাজ করেন এবং এটি সম্ভবত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল।
এখানে চীন সরবরাহকৃত তিনটি ছোট গবেষণা রিয়্যাক্টর, একটি রূপান্তর কেন্দ্র, জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র, জিরকোনিয়াম ক্ল্যাডিং প্লান্ট এবং অন্যান্য গবেষণাগার ও সুবিধা রয়েছে।
নাতানজ, ফোর্দো এবং ইস্পাহান, এই তিন স্থাপনাই ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার মেরুদণ্ড। এই তিন স্থাপনায় মার্কিন হামলা ইরানের ভবিষ্যৎ পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এর প্রকৃত মাত্রা ও প্রতিক্রিয়া এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
সূত্র: সিএনএন
এমজেএফ