ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২, ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

ভারতের উত্তর প্রদেশে রুহুল্লাহ খোমেনির ভুলে যাওয়া শেকড়

আন্তজার্তিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০০, জুলাই ৬, ২০২৫
ভারতের উত্তর প্রদেশে রুহুল্লাহ খোমেনির ভুলে যাওয়া শেকড় আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, যার ছবি  মুদ্রায়, শ্রেণিকক্ষে, সরকারি ভবনসহ ইরানের সর্বত্র দেখা যায় তিনি ছিলেন ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের নেতা। যে বিপ্লব ইরানে পশ্চিমা-সমর্থিত শাহকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে এবং ইরানকে চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ১৯৮৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছিল, খোমেনির প্রভাব ছাড়া ওই বিপ্লব সম্ভব হতো না।  

খোমেনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য, একবার তিনি বলেছিলেন, ইসলামই রাজনীতি।

খোমেনির বিশ্বাস গঠিত হয়েছিল খুব শৈশবে। তিনি দাদা সৈয়দ আহমদ মুসাভি হিন্দির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিয়া মতাদর্শের গভীর সংযোগে বড় হন। যার শেকড় ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাবানকি জেলার বারাবানকি শহরে।

ভারতের উত্তর প্রদেশের সঙ্গে খোমেনির সংযোগ

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনির শিকড় ভারতের উত্তর প্রদেশে বারাবানকি জেলার নিঃশব্দ গ্রাম কিন্তুরে। তার অনুপ্রেরণা ছিল তার দাদা আহমদ মুসাভির আধ্যাত্মিক পথ।

আহমদে মুসাভির ভারত থেকে ইরানে গমন ইরানি রাজনীতি ও ধর্মীয় জীবনে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। খোমেনি পরে ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা হন এবং দেশটিকে একটি ধর্মতন্ত্রে রূপান্তর করেন।

আহমদ মুসাভির বাবা দিন আলী শাহ, ১৭০০ দশকে মধ্য ইরান থেকে ভারতে এসেছিলেন। ১৮০০ সালের দিকে জন্ম নেয়া আহমদ বারাবানকি জেলার কাছে, লখনউ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বড় হন, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বাড়ছিল।

তিনি ছিলেন সেসব পণ্ডিতদের একজন, যারা বিশ্বাস করতেন ইসলামকে পুনর্জাগরিত করতে হবে এবং মুসলিমদের সমাজে তাদের স্থান পুনরুদ্ধার করতে হবে।

আহমদ হিন্দি এমন এক জীবন চেয়েছিলেন যেখানে তিনি তার ঈমানে এগোতে পারেন এবং অন্যদেরও তা শেখাতে পারেন। তাই ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে তিনি ইরাক (তখন পারস্য নামে পরিচিত) হয়ে ১৮৩০ সালে নাজাফে হযরত আলীর কবর জিয়ারত করতে যান।

১৮৩৪ সালের মধ্যে তিনি ইরানের খোমেন শহরে চলে যান, সেখানে একটি বাড়ি কেনেন এবং পরিবার শুরু করেন। তার যাত্রা ছিল ঈমানের প্রতি অঙ্গীকার এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছার ফল।

খোমেনে তিনবার বিয়ে করেন এবং পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেন। এদের একজন ছিলেন মোস্তাফা, যিনি ১৯০২ সালে জন্ম নেয়া রুহুল্লাহ খোমেনির পিতা।

আহমদ হিন্দি ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং আমৃত্যু তার নামের সঙ্গে 'হিন্দি' যুক্ত রাখেন ভারতীয় পরিচয়ের স্মারক হিসেবে। তিনি কারবালায় সমাহিত আছেন।

যদিও তিনি খোমেনির জন্মের অনেক আগে মারা যান, তবে তার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে খোমেনিকে গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখে।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির উত্থান

আহমদ মুসাভির নাতি রুহুল্লাহ খোমেনি ১৯০২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদার ভারত ত্যাগের এক শতাব্দী পরে তিনি এক বিশিষ্ট আলেম ও শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির কট্টর সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি পশ্চিমা-সমর্থিত রাজতন্ত্র ও ইরানের ধর্মনিরপেক্ষীকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে পরিচিত হন।

১৯৭৯ সালে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। খোমেনির জ্বালাময়ী ভাষণ ও গণবিক্ষোভ শাহের সরকার পতনে ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রাখে।  

পরে খোমেনি সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ইরানকে ইসলামি ফিকাহভিত্তিক কঠোর ধর্মতন্ত্রে রূপান্তর করেন। যদিও তিনি দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন, খোমেনি ছিলেন সাদাসিধে জীবনযাত্রার প্রতীক।  

তিনি তেহরানে একটি সাধারণ একতলা বাড়িতে বাস করতেন, কোনো আড়ম্বর ছাড়াই। এমনকি সেই বাড়িটি যখন মেহেদি ইমাম জামেহ বিনামূল্যে দিতে চেয়েছিলেন, খোমেনি হাজার রিয়াল দিয়ে দাম পরিশোধ করেন।

তিনি কখনো তার দাদার সাক্ষাৎ পানননি, তবে পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থা ও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় চেতনা খোমেনির দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার মতবাদ ছিল আহমদ মুসাভির ইসলামি পুনর্জাগরণের চিন্তার ধারাবাহিকতা।

খোমেনি আর খামেনির মধ্যে রক্তের সম্পর্কে নেই

যদিও খোমেনির উত্তরাধিকার এখনো ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোয় বিদ্যমান, তবে মনে রাখা জরুরি যে বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি খোমেনির পরিবারের কেউ নন।

খামেনি এক ভিন্ন আলেম পরিবার থেকে এসেছেন, যার ভারতীয় বংশধারার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি ছিলেন খোমেনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তবে উভয় নেতার মাঝে আদর্শিক বন্ধন গভীর।

আলী খামেনি ১৯৩৯ সালে উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদ শহরে এক ধর্মীয় পণ্ডিতের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ শহরের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করেন এবং পরে শিয়া পবিত্র নগরী কোম-এ চলে যান।

১৯৬২ সালে তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন।

১৯৮১ সালের জুন মাসে তেহরানের এক মসজিদে বোমা হামলায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। এই হামলার জন্য একটি বামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। এই ঘটনায় তার ডান হাত চিরতরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।

দুই মাস পর একই গোষ্ঠী ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলি রাজাইকে হত্যা করে। এরপর আলী খামেনিকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তখন প্রেসিডেন্টের পদটি মূলত প্রতীকী ছিল এবং খামেনি এই পদে আট বছর ছিলেন।  

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু হয় ১৯৮৯ সালের জুন মাসে। এর পর ‘মজলিসে খোবরেগান’ (ধর্মীয় আলেমদের একটি পরিষদ) আলী খামেনিকে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচন করে, যদিও তখন তিনি শিয়া আলেমদের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মর্যাদা ‘মারজা-এ-তাকলিদ’ (অনুকরণযোগ্য ধর্মীয় নেতা) বা ‘গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ’ অর্জন করেননি।

এই সংকট সমাধানের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়, যেখানে বলা হয় সর্বোচ্চ নেতাকে ‘ইসলামি বিদ্যায় পারদর্শিতা’ দেখাতে হবে, যাতে আলী খামেনির নির্বাচন করা সম্ভব হয়। একইসঙ্গে তাকে রাতারাতি ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ থেকে ‘আয়াতুল্লাহ’ পদে উন্নীত করা হয়।

খোমেনির মতোই খামেনিও ইরানের পররাষ্ট্রনীতিকে পশ্চিমা দেশ, ধর্মনিরপেক্ষ প্রভাব এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছেন।

যখন পশ্চিম এশিয়া আবার নতুন যুদ্ধের আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে, তখন প্রায় দুই শতাব্দী আগে বারাবানকির এক আত্মিক যাত্রার প্রতিধ্বনি এখনো প্রতিফলিত হচ্ছে।

উত্তরাধিকার নিয়ে খোমেনির দৃষ্টিভঙ্গি 

বিবিসি পার্সিয়ানের একটি জরিপে দেখা গেছে—৩০ জন ইরানি বিশেষজ্ঞের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দ্বিতীয় পুত্র মোজতবা হয়তো তার পিতার উত্তরসূরি হতে পারেন। তবে ইরানের নিজের রাজনৈতিক কাঠামোই এ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

দেশটিতে উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের ধারণাটিকে ব্যাপকভাবে “অইসলামিক” বা ইসলামবিরোধী হিসেবে দেখা হয়।

১৯৭৯ সালের বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি পরিবারের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং একে রাজতন্ত্রের মতোই নিন্দনীয় বলেছেন।

এই বিষয়ে তার ভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে সাহিফায়ে ইমাম খোমেনি নামে ২১ খণ্ডের একটি সংকলনে, যেখানে তার বক্তৃতা, চিঠিপত্র ও অন্যান্য লেখা একত্রে সংরক্ষিত আছে।

১৯৮৯ সালে খোমেনির মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকারী খামেনিও বারবার বলেছেন, উত্তরাধিকারভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ইসলামি শাসনের জন্য উপযুক্ত নয়।

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।