ঢাকা, সোমবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২, ০৭ জুলাই ২০২৫, ১১ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

আইডিএফের জন্ম ও ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস (পর্ব-৩)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ঢল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:১৮, জুলাই ৬, ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ঢল ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ৩৭৪ জন ইহুদি অভিবাসনকারীকে নিয়ে একটি জাহাজ হাইফায় পৌঁছায়

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের ‘সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী’ হিসেবে প্রচার করে। বাস্তবতা হলো, এই দাবি কেবল প্রচারণা মাত্র, যদি না আপনি সেটাতে বিশ্বাস করেন।

আইডিএফ দাবি করে, যুদ্ধের সময় বেসামরিক মানুষের অধিকারের ব্যাপারে তারা সবচেয়ে বেশি সচেতন। কিন্তু গাজার যুদ্ধাপরাধকে একপাশে রেখে, পশুপ্রেমী, সমকামীবান্ধব বা ধর্মীয় সহনশীলতার যে চিত্র আইডিএফ তুলে ধরার চেষ্টা করে, এর বাইরেও প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত ইতিহাস অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন। আইডিএফ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের একই বয়ানের অন্তর্ভুক্ত।

সেই ইতিহাসের কিছু অংশ ‘আইডিএফের জন্ম ও ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস’ শিরোনামে বাংলানিউজে তুলে ধরা হয়েছে। চার পর্বের ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্বে থাকছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ইহুদি শরণার্থীদের ঢল, ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ময়েন হত্যা, হান্টিং সিজন ও ব্ল্যাক সাবাথ, জাতিসংঘের পার্টিশন পরিকল্পনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ইহুদি শরণার্থীদের ঢল
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ে তখন ব্রিটিশদের ব্যস্ততা কাজে লাগিয়ে ডেভিড বেনগুরিয়ান মনোযোগ দেন ইউরোপ থেকে ইহুদি শরণার্থীদের অবৈধভাবে প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসার পরিকল্পনায়।

তিনি হাগানাহ ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে একটির পর একটি জাহাজ পাঠাতে থাকেন, যার মাধ্যমে হাজার হাজার ইহুদিকে নতুন ইয়েশু অঞ্চলগুলোতে গোপনে এনে রাখা হতো।

এই সময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছে যায়। যদিও ব্রিটিশরা ইহুদি অভিবাসনের সরকারি পথগুলোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখে।

কিন্তু যখন হলোকাস্টের ভয়াবহতা প্রকট হয়ে উঠতে থাকে, তখন জায়নবাদীরা ও ইরগুন, যারা এক সময় ব্রিটিশদের সঙ্গে মিলে আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে একজোট হয়েছিল; তারা ক্ষুব্ধ হয় এবং চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ময়েন হত্যা
১৯৪৪ সালের মধ্যে জেভ জাবোতিনস্কির একজন তরুণ, নিবেদিত অনুসারী মেনাখেম বেগিন ইরগুন মিলিশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সেই বছরই তিনি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং জেরুজালেম, তেল আবিব ও হাইফায় অভিবাসন অফিসগুলোতে একের পর এক বোমা হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেন। এরপর তিনি আক্রমণ করেন কর কর্মকর্তাদের ওপর, তারপর পুলিশ স্টেশনগুলোতে।

এ সময় লেহি (স্টার্ন গ্যাং)-ও যুক্ত হয় এবং ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুঃসাহসী হামলায় অংশ নেয়, যার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর, যখন ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মন্ত্রী ওয়াল্টার এডওয়ার্ড গিনেস (যিনি লর্ড ময়েন নামে পরিচিত) কায়রোতে নিজের বাড়ির বাইরে লেহির দুই সদস্যের গুলিতে নিহত হন।

তার মৃত্যু গোটা অঞ্চলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ফিলিস্তিনে জায়নবাদীদের নিয়ন্ত্রণের লড়াই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

লেহি ও ইরগুন লর্ড ময়েনকে ইহুদি অভিবাসনবিরোধী শ্বেতপত্রের অন্যতম কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত করেন এবং তার হত্যাকে উইনস্টন চার্চিলের প্রতি একটি বার্তা হিসেবে ব্যবহার করে।

এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং লেহির শীর্ষ নেতাদের একজন ইয়িৎসহাক শামির পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, লর্ড ময়েন ছিলেন ইহুদি অভিবাসনের ঘোরতর বিরোধী। তিনি বিশ্বাসই করতেন না যে, ইহুদি জাতি বা কোনো ইহুদি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে। তাই আমরা এই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিই।

হান্টিং সিজন ও ব্ল্যাক সাবাথ
এটি ইয়িৎসহাক শামির শেষ হত্যাকাণ্ড ছিল না। ব্রিটেন, তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে আছে, তারা বেনগুরিয়ান এবং অন্যান্য জায়নবাদী নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, যাতে এই হামলাগুলো বন্ধ করা হয়।

হাগানাহ এরপর ইরগুন ও লেহির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে শুরু করে। হাজার হাজার সদস্যকে হত্যা অথবা আটক করা হয়। এই সময়কাল ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘হান্টিং সিজন’ নামে।

গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কায়, মেনাখেম বেগিন তার যোদ্ধাদের আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। কারণ তিনি জানতেন যে, তাদের কট্টরপন্থী কর্মকাণ্ড ইয়েশুভে বসবাসকারী ইহুদি জনসংখ্যার মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

এই কৌশল সফল হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই হাগানাহ ও ব্রিটিশদের মধ্যে চলমান সহযোগিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে জায়নবাদী নেতারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং বেগিন ও স্টার্ন গ্যাংয়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ইহুদি প্রতিরোধ আন্দোলন গঠনে রাজি হন।

এই তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জোট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হামলা আরও বৃদ্ধি করে এবং ফিলিস্তিনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো যেমন: রেলপথ, সেতু, কারাগার ও পুলিশ স্টেশন হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

ইয়েশুভ ইহুদি জনগোষ্ঠী তখন ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা শুরু করেছিল যে, ব্রিটিশরা একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং অভিবাসন সীমাবদ্ধতা বাতিল করতে হবে, যাতে যুদ্ধশেষে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে গ্রহণ করা যায়।

তবে এই জোট গোপন রাখা হয়, কারণ জায়নবাদী নেতারা ইউরোপে তাদের অবস্থান রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ফাঁস হয়ে যায়, ‘অপারেশন আগাথা’ চলাকালে এই গোপনীয়তা, যা ‘ব্ল্যাক সাবাথ’ নামেও পরিচিত।

ব্রিটিশ বাহিনী ইহুদি বসতিতে ব্যাপক অভিযান চালায়, হাজার হাজার জায়নবাদী কর্মী ও যোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে এবং বিপুল নথিপত্র উদ্ধার করে, যা প্রমাণ করে যে জিউশ এজেন্সি ডেভিড বেনগুরিয়ান ও হাগানাহসহ লেহি ও ইরগুনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছিল, যদিও এ দুটি সংগঠনই ব্রিটিশদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত ছিল।

জাতিসংঘের পার্টিশন পরিকল্পনা
এই অভিযানে (অপারেশন আগাথা) ইহুদি যোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তা জোটের নাজুক সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলে। এর প্রতিশোধ হিসেবে মেনাখেম বেগিন ইরগুনকে নির্দেশ দেন জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে হামলা চালাতে।

এই হোটেলেই ছিল ব্রিটিশ গোপনচর সংস্থা ও সামরিক প্রশাসনের ঘাঁটি এবং সেখানেই সংরক্ষিত ছিল অভিযানে জব্দকৃত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র।

১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই, ইরগুনের সদস্যরা হোটেলের বেসমেন্টে ৩৫০ কেজি বিস্ফোরক স্থাপন করে এবং দক্ষিণ দিকের অংশ উড়িয়ে দেয়। এতে ৯১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ৪১ জন ফিলিস্তিনি, ২৮ জন ব্রিটিশ নাগরিক এবং ১৭ জন ইহুদি ছিল।

এই হামলার ধাক্কায় হাগানাহ আবারও পিছিয়ে যায় এবং ব্রিটেন জায়নবাদী কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন আরও জোরদার করে। তবে ইরগুন ও লেহি তাদের হামলা অব্যাহত রাখে ব্রিটিশ পুলিশদের হত্যা ও অপহরণ করে, এমনকি ইউরোপেও হামলা শুরু করে।

তিন মাস পর, তারা ইতালিতে ব্রিটিশ দূতাবাস উড়িয়ে দেয়। এরপর ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে, লেহির সদস্যরা একটি ট্রাকে বিস্ফোরক ভরে হাইফার ব্রিটিশ পুলিশ স্টেশনে আঘাত হানে।

এই ঘটনাকে ধরা হয় বিশ্বের প্রথম ট্রাক বোমা হামলা হিসেবে। তারপর মার্চে, তারা লন্ডনের ব্রিটিশ কলোনিয়াল ক্লাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠতে না পারা এবং বেশিরভাগ উপনিবেশেই চলমান সংঘাত সামলাতে হিমশিম খাওয়া ব্রিটেন জাতিসংঘের কাছে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের আবেদন জানায়।

তখনকার জাতিসংঘে মাত্র ৫৭টি সদস্য রাষ্ট্র ছিল। তারা ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকে তিন ভাগে বিভক্ত করার পক্ষে ভোট দেয়। এর মধ্যে ৫৫ শতাংষ জমি ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়, যদিও তারা পুরো জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কম ছিল।

কিন্তু ইহুদিদের জন্য প্রস্তাবিত এলাকাগুলোতেই একটি গুরুতর জনসংখ্যাগত সমস্যা ছিল, কারণ সেই সব এলাকার অর্ধেক বাসিন্দাই ছিল ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং সদ্য গঠিত আরব লিগের কাছে সহায়তা চায়।

এই সময়টাতে ব্রিটিশ সরকার মনে করল এই পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব এখন আর তাদের নয়। তারা ঘোষণা করে, ১৯৪৮ সালের ১৫ মে তারা ফিলিস্তিন থেকে শাসন ও সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।

এই ঘোষণার পরপরই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ফিলিস্তিনিদের ও ইহুদিদের (ইয়েশুভ) মধ্যে।

আরও পড়ুন:
আইডিএফের জন্ম ও ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস (পর্ব-১)
ইহুদি রাষ্ট্র পেতে হিটলারের পক্ষেও যুদ্ধের প্রস্তাব দেয় জায়নিস্টরা

এমএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।