ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা ও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা থামাতে দেশটির বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের টার্গেট করে আসছে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইরানের প্রায় ২০ জন পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিবিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এর মধ্যে কদিন আগেই ১২ দিনের যুদ্ধেই জীবন দিয়েছেন ১৩ জন। ১৩ জুনের অতর্কিত হামলায় শহীদ হয়েছেন ইরানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খাতের দুই উদ্ভাবক, মোহাম্মদ রেজা জাকারিয়ান ও মাজিদ তাজেনজারি।
তাদের জীবন, কর্ম, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম নিয়ে তেহরান থেকে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।
ধ্বংসস্তূপে লেখা প্রতিভার রক্তচিহ্ন
উত্তর-পূর্ব তেহরানের একটি নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় গত ১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েলি বাহিনী বোমাবর্ষণ করে একটি বহুতল ভবন ধ্বংস করে দেয়। ওই বর্বরোচিত হামলায় নিহত হন দুই তরুণ ও বিশ্বস্বীকৃত ইরানি প্রযুক্তিবিদ— মাজিদ তাজেনজারি, (একজন এআই প্রযুক্তিবিদ ও উদ্ভাবক) এবং মোহাম্মদ রেজা জাকারিয়ান (প্রতিরক্ষা সংযুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রণী গবেষক)।
হামলায় জাকারিয়ানের স্ত্রী শাহিদা যয়নব নাবিজাদে ও তাদের দুই কন্যা পাঁচ বছরের ফাতেমা ও সাত মাসের জাহরারও প্রাণ যায়। এ ছাড়া, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে নিহত হন বহু নারী ও শিশু। হামলার পরদিন ধ্বংসস্তূপে উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের নাতনিদের খুঁজছিলেন জাকারিয়ানের বাবা।
তিনি ফুঁসে ওঠা কণ্ঠে বলছিলেন— তোমরা কীভাবে এতটা নিচে নেমে গেলে? আমার ছেলে কেন তোমাদের চোখের কাঁটা হয়ে গেল? তার স্ত্রী-সন্তানদের বাচ্চাদের কী দোষ ছিল? প্রতিবেশীরাই বা কী অপরাধ করেছিল? লজ্জিত হও।
দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীর এক অর্থবোধক জীবন
জাকারিয়ান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। তিনি ইস্পাহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক এবং মালেক আশতার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ইরানে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি গবেষণার প্রাণকেন্দ্র।
তার বাবা মোহাম্মদ হোসেন জাকারিয়ান বলেন, আমার ছেলে বহু বিদেশি বৃত্তি ও চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিল। কিন্তু সে জানত, তার আসল কাজ দেশের মাটিতে। সে শহীদ হয়েছে—এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
তিনি আরও বলেন, আমি গর্বিত যে এমন সন্তান দেশকে উপহার দিতে পেরেছি। কিন্তু এই শত্রু এমনই পাষণ্ড যে, তারা আমার দুই নাতনিকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
জাকারিয়ানের জানাজা ও দাফন হয় মাজানদারানের বাবোল শহরের আমিরকালা এলাকার একটি কবরস্থানে। হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। শহীদ হওয়ার আগে তাকে অনেকেই চিনতেন না, কিন্তু শহীদ হওয়ার পর তাকে মনে রাখবে প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে।
তাজেনজারি: এক বিজ্ঞানীর হাতে লেখা এআই বিপ্লব
৩৫ বছর বয়সী মাজিদ তাজেনজারি ছিলেন একজন অধ্যাপক, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদ। তার বাড়ি ছিল ইরানের মাজানদারান প্রদেশের আমোল শহরের পাশের গ্রাম তাজেনজার। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং ইরানের যুব চেম্বার অব কমার্সের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কমিশনের আওতাধীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কমিটির প্রধান।
পাশাপাশি, তিনি ছিলেন এইআইওলার্ন নামের একটি এআই ও প্রোগ্রামিং একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তার মাস্টার্স গবেষণার বিষয় ছিল নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণ। পিএইচডি গবেষণায় তিনি তৈরি করেন একটি দ্বিভাষিক রোবট, যা ফারসি ও ইংরেজি উভয় ভাষায় কথা বলতে পারত।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি
২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিযোগিতায় তিনি স্বর্ণপদক অর্জন করেন। পরে ২০১৫ সালে চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ইনভেনশন কম্পিটিশনে তিনি আবারও স্বর্ণপদক লাভ করেন।
জার্মানির নুরেমবার্গে আয়োজিত বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ ছাড়া রাশিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া এবং মস্কো থেকে তিনি বিভিন্ন সময় সম্মাননা পেয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন
তিনি উদ্ভাবন করেন অ্যাডভান্সড অ্যানালাইটিক্যাল ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ওয়্যারলেস পুমসে সিস্টেম, যা তায়কোয়ান্দো রেফারিদের স্কোরিং ও বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও নির্ভুল ও কার্যকর করে তোলে। এটি ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারকে এগিয়ে নিয়েছে।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রিঅ্যাক্ট্যান্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি উদ্ভাবন করেছেন কার্গো কনটেইনার স্ক্যানিং সিস্টেম, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য করেছে। এটি বন্দর ও সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি তৈরি করেছেন নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তায়কোয়ান্দো স্কোরিং সিস্টেম, যা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ব্যবহার উপযোগী এবং রেফারিদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ করে তোলে।
উদ্ভাবন করেছেন একটি স্মার্ট সিটি গেট, যা শহরের প্রবেশ ও প্রস্থান নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমাধান। স্বাস্থ্যখাতে প্রযুক্তি যুক্ত করতে তিনি কাজ করেছেন লোকেশন ট্রান্সমিশন সুবিধাসম্পন্ন স্মার্ট ব্লাড প্রেশার ও হার্ট রেট মনিটর নিয়ে।
উন্নত সময় ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি তৈরি করেছেন স্মার্ট ওয়্যারলেস টাইম রেকর্ডিং সিস্টেম, যা বিভিন্ন শিল্প ও ক্রীড়া ইভেন্টে সময় নিরূপণ ও বিশ্লেষণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। এ ছাড়া তিনি উদ্ভাবন করেছেন এক অভিনব যানবাহন, যা প্যারালাল পার্কিংয়ের সময় দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিকেই চলাচল করতে সক্ষম।
শিক্ষক, উদ্ভাবক ও সমাজবিজ্ঞানী
ইরানের বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হাদি জাহেদি বলেন, তাজেনজারির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—পরিবর্তন শুরু হয় সাত বছর বয়সে। তাই তিনি শিশু ও কিশোরদের জন্য একটি প্রোগ্রামিং ও এআই প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করেন, যা অল্প সময়েই সারা দেশে সৃজনশীলতার জোয়ার বইয়ে দেয়।
তাজেনজারি মনে করতেন, ‘গবেষণা তখনই অর্থবহ, যখন তা বাস্তব জীবনের কোনো সমস্যা সমাধানে কাজে লাগে’। তার উদ্ভাবন ইতোমধ্যেই ইরানের শিল্পখাতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল—চেহারা শনাক্তকরণ, স্টিলের মান যাচাই, পণ্য স্ক্যানিং ইত্যাদি কাজে। তার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যমে এমন দক্ষতা অর্জন, যেন তা বাস্তব সমস্যার সমাধানে কাজে আসে।
শাহাদাত মানে থেকে যাওয়া নয়
ইসরায়েল বহু বছর ধরেই ইরানের বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যা, সাইবার হামলা ও গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে, যাতে দেশটির আত্মনির্ভর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তবে, শহীদ জাকারিয়ানের বাবার কথাতেই উঠে আসে ইরানের জাতীয় চেতনার প্রতিধ্বনি— ওরা ভাবে, বিজ্ঞানীদের মেরে দিয়ে আমাদের অগ্রগতি থামানো যাবে। কিন্তু নতুনেরা উঠে আসবে। পথ এখানেই শেষ নয়।
এই শব্দগুচ্ছ আজ গোটা ইরানের প্রতিচ্ছবি। যেখানে শাহাদাত মানে থেমে যাওয়া নয়, বরং নতুন যাত্রার শপথ। ইরান জানিয়ে দিয়েছে— এই হত্যাকাণ্ড তাদের থামাতে পারবে না, বরং প্রতিটি শহীদের রক্তই জ্বালাবে জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের দীপ্ত শিখা।
আরএইচ