দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার আয়োজিত এক জাঁকাল কুচকাওয়াজে চীন তাদের সামরিক শক্তির সক্ষমতা দেখাল।
হাজার মাইল দূরে ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই বিশাল আয়োজনে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে চীনের সামরিক শক্তির প্রদর্শন সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিস্তারিত কিছু বলেননি, শুধু এটুকুই বলেছেন যে এটি ছিল ‘খুব, খুবই চমকপ্রদ’।
তবে বার্তা স্পষ্ট— বিশ্বে এক নতুন শক্তি জেগে উঠছে, যা আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
সেদিন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ক্যারল নাভরোকির সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প এ বিষয়ে খুব একটা কিছু বলেননি। গত কয়েকদিনে চীন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্বিধা, ক্ষোভ আর উদ্বেগের এক জটিল মিশ্রণ।
মঙ্গলবার এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ছিলেন বেশ নির্লিপ্ত। তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনসহ দুই ডজন রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে চীনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন নিয়ে তিনি ‘উদ্বিগ্ন নন’।
তবে মঙ্গলবার রাতেই নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি অভিযোগ করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার স্বীকৃতি চীন দিচ্ছে না। তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সময় ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একপাশে রাখলে ট্রাম্পের সামরিক কুচকাওয়াজ ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ রয়েছে। গত মাসে তিনি আলাস্কায় পুতিনকে স্বাগত জানান গোপন বোমারু বিমানের উড্ডয়ন ও মার্কিন সামরিক জেটসজ্জিত লাল কার্পেটের মাধ্যমে।
প্রথম মেয়াদে তিনি ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজের স্মৃতিও গর্বের সঙ্গে মনে করেন। এমনকি দুই মাস আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ২৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি নিজেই এক সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজন করেছিলেন।
বেইজিংয়ের আধুনিক অস্ত্র আর নিখুঁত পদযাত্রার বিপরীতে ট্রাম্পের কুচকাওয়াজ ছিল একেবারেই সাধারণ। হোয়াইট হাউসের পাশে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে চলে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্যাংক আর পুরোনো যুগের সৈন্যরা।
আসলে এটি ছিল স্মৃতিতে ফেরার এক আয়োজন। এই আয়োজন ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগানের সঙ্গে মিলে যায়। তার অর্থনৈতিক ভাবনাও অনেকটা উনিশ শতকের বাণিজ্যনীতির মতো, যে সময়টাকে তিনি আমেরিকার সবচেয়ে ভালো সময় বলে মনে করেন।
অবশ্য চীনের কুচকাওয়াজে ভবিষ্যৎধর্মী অস্ত্রশস্ত্রের ঝলক থাকলেও সেখানে ইতিহাসের ছোঁয়াও ছিল। কমিউনিস্ট সরকার চেষ্টা করেছে দাবি করতে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পরাজয়ে তাদের ভূমিকা ছিল বড়। যদি সেই যুদ্ধকে বলা হয় ‘আমেরিকান শতাব্দী’র সূচনা, তবে বেইজিং আশা করছে তাদের অবদান নতুনভাবে স্বীকৃতি পেলে তা ‘চীনা শতাব্দী’ গড়ার পথে সহায়ক হবে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভেটেরান্স অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী রিচার্ড উইলকি বলেন, এটি হলো নিয়মকানুন নতুন করে লেখার প্রথম ধাপ। আর সেই কাজ শুরু হয় ইতিহাস নতুন করে লেখার মাধ্যমে।
তিনি আরও যোগ করেন, এশিয়ায় জাপানের পরাজয়ে কমিউনিস্ট সেনাদের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল চীনা জাতীয়তাবাদী বাহিনী আর মার্কিন সেনাদের।
এখন চীনের কুচকাওয়াজের ছবিই একমাত্র বিষয় নয়, যা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করেছে। যারা আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা ধরে রাখতে চান, তাদের জন্য চীনের আরও কিছু বার্তা ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে।
সোমবার তিয়ানজিনে এক অর্থনৈতিক সম্মেলনে শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, চীন-ভারতের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ক কিছুটা হলেও গলছে। আর এর পেছনে বড় কারণ হলো ট্রাম্পের শুল্কনীতি, যা এই দুই দেশকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি বিশ্ব বাণিজ্য ও রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের নেতাদের মধ্যে নতুন করে তৈরি হওয়া বোঝাপড়া স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে, ভূরাজনীতির বড় অংশীদাররা এখন নতুনভাবে একত্রিত হচ্ছে। যদিও এটি চ্যালেঞ্জিং, তবুও একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়।
ট্রাম্প অবশ্য মনে করেন, শুল্ক আরোপই তার পরিকল্পনার মূল ভিত্তি, যার মাধ্যমে তিনি মার্কিন শিল্প রক্ষা করবেন এবং ফেডারেল সরকারের জন্য নতুন রাজস্ব সংগ্রহ করবেন। কূটনৈতিক ক্ষতি যদি হয়ও, আপাতত তিনি তা মেনে নিতে প্রস্তুত।
ট্রাম্প-সমর্থিত আমেরিকা ফার্স্ট ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের আমেরিকান সিকিউরিটির কো চেয়ার উইলকি বলেন, কোরীয়, জাপানি, ফিলিপিনো আর ভিয়েতনামিরা জানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ছোটখাটো সমস্যা আসল হুমকি নয়। আসল হুমকি হলো ক্রমবর্ধমান চীনা সামরিক শক্তি।
ট্রাম্প আবারও দেখিয়েছেন, দূরবর্তী সংঘাত ও উদ্বেগ নিয়ে তিনি খুব বেশি মাথা ঘামান না। বরং তার নজর কেন্দ্রীভূত থাকে আমেরিকার আশপাশের ভূখণ্ডে—গ্রিনল্যান্ড, পানামা, কানাডা ইত্যাদি স্থানে।
কিন্তু ট্রাম্পের জন্য বিপদের জায়গা হলো, তার বাণিজ্যনীতি শেষ পর্যন্ত হয়তো ঝুঁকিই হয়ে দাঁড়াবে, ফল আসবে না। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, তার তৈরি আমেরিকা-কেন্দ্রিক বাণিজ্য কাঠামো আদালতে ভেঙে পড়তে পারে।
শুক্রবার এক আপিল আদালত রায়ে বলেন, ট্রাম্পের অনেক শুল্ক ফেডারেল আইনের ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাবেন। যদিও কনজারভেটিভ বিচারকরা প্রায়ই ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেন, তবুও তারা কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া প্রেসিডেন্টদের ব্যাপক ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়ে সবসময় সতর্ক। তাই নিশ্চয়তা নেই যে তারা ট্রাম্পের এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করবেন।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রাম্প নিজস্ব পথে হেঁটেছেন—আমেরিকাকে এক নাটকীয় নতুন যাত্রায় নিয়ে গেছেন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এটি তার এক উচ্চাভিলাষী কৌশল। এই কৌশল নিয়ে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমেরিকাকে দ্বিতীয় সোনালি যুগে নিয়ে যাবেন। তবে বিপদও কম নয়—তা হোক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে কুচকাওয়াজের ময়দানে বা আমেরিকান আদালতকক্ষে।
আরএইচ