উত্তপ্ত ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখ। কাশ্মীরঘেঁষা অঞ্চলটিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলন বুধবার (২৪) সেপ্টেম্বর) প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নেয়।
বিবিসি বাংলা বলছে, লাদাখে ১৯৮৯ সালের পরে এত বড় সহিংসতা এই প্রথম দেখা গেল। সেখানকার প্রধান শহর লেহতে কারফিউ বাস্তবায়নে পুলিশের পাশাপাশি আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, পরিস্থিতি সমাধানে লেহতে একজন ‘বিশেষ দূত’ পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কোবিন্দর গুপ্তর সভাপতিত্বে একটি নিরাপত্তা পর্যালোচনা সভা হয়েছে, যেখানে শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
লাদাখ অঞ্চলটি আগে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যেরই অন্তর্গত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা–৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময়েই লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়।
দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে এলেও ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই যুবকরা রাস্তায় নেমে পড়েন এবং অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালাতে থাকেন। এরপরে তারা বিজেপির কার্যালয়েও হামলা চালান, সেখানে থাকা গাড়ি জ্বালিয়ে দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুরো লেহ শহরেই পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কোবিন্দর গুপ্ত সংঘাতের ঘটনাটিকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এখানে পরিস্থিতির অবনতি যারা ঘটাচ্ছে, তাদের আমরা ছাড়ব না।
আলোচনায় ‘থ্রি ইডিয়েটস’ খ্যাত সোনম ওয়াংচুক
এই সংঘাত ঘিরে আলোচনায় এসেছেন বলিউডের সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়েটস’ খ্যাত লাদাখের শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক। লাদাখের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা আদায়ে তার নেতৃত্বে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ জন অনশন শুরু করেন, তাদের মধ্যে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। তারপরই ‘লাদাখ এপেক্স বডি’র যুব সংগঠন হরতালের ডাক দেয়, যেখান থেকে সহিংসতা হয়।
সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ওয়াংচুক। কিন্তু ২৪ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকেই দায়ী করেছে। এমনকি ওয়াংচুকের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈদেশিক অনুদান সংক্রান্ত একটি অভিযোগের তদন্তও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই। এমনকি তার স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ বা ‘সেকমল’র ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট বা এফসিআরএ নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে আর কোনো তহবিল গ্রহণ করতে পারবে না ওয়াংচুকের এই প্রতিষ্ঠান।
বিবিসির খবর অনুসারে, অনশন চলাকালে একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলন করে সোনম ওয়াংচুক বলেন, ৭২ বছর বয়সী তে্সরিং ওয়াংচুক এবং ৬০ বছর বয়সী তাশি ডোলমার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়েছে, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। এই ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।
ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তিনি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে আরব স্প্রিংয়ের মতো আন্দোলনের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং নেপালের জেন-জির বিক্ষোভের কথাও বলেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ওয়াংচুকের উত্তেজক ভাষণে উত্তেজিত হয়ে অনশনস্থল থেকে বেরিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের দফতর এবং কিছু সরকারি দফতরে হামলা চালানো হয়।
এদিকে সহিংসতার পরে সোনম ওয়াংচুক তার অনশন আন্দোলন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং যুবসমাজের প্রতি ভাঙচুর না করার আবেদন জানান।
তিনি বলেন, যুবসমাজ সহিংসতা বন্ধ করুক, কারণ এতে আমাদেরই আন্দোলনের ক্ষতি হবে, পরিস্থিতির অবনতি হবে।
এই শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী বলেন, লাদাখে গণতন্ত্র নেই এবং সাধারণ মানুষের কাছে এই অঞ্চলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও পূরণ করা হয়নি।
উত্তরপূর্বের ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম আর আসামের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল কার্যকর। এই তফসিল অনুযায়ী প্রশাসন, রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ক্ষমতা, স্থানীয় প্রশাসন পরিচালন ব্যবস্থা, বিকল্প বিচার ব্যবস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে।
সহিংসতার পর কংগ্রেস নেতা ফুন্তসোগ স্তানজিন তে্সপগের বিরুদ্ধে অনশনস্থলে উত্তেজক ভাষণ দেওয়ার মামলা দায়ের হয়েছে।
বিজেপি অভিযোগ করছে, এই সহিংসতা কংগ্রেসের এক ‘ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র’, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ, নেপাল আর ফিলিপাইনের মতো পরিস্থিতি ঘটাতে চেয়েছিল দলটি।
অবশ্য কংগ্রেস এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
এইচএ/