ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

মালভিকার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪
মালভিকার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

ঢাকা: ‘কৌতূহলের’ কারণে বিস্ফোরণে মাত্র ১৩ বছর বয়সে হারান দু’হাত। খানিক চামড়ায় জোড়া লেগে থাকে বাম পা।

ফের দাঁড়ানো নিয়ে তৈরি হয় সংশয়।  

মনের জোর, সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসের কারণে সবকিছু জয় করতে সক্ষম হন তরুণী মালভিকা আয়ার। এক সময়ের ‘বিকলাঙ্গ’ মালভিকা এখন সমাজকর্মী, শ্রোতা মুগ্ধ বক্তা ও মডেল।

আরো একটি পরিচয় রয়েছে তার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল শেপারস কমিউনিটির চেন্নাইয়ের গ্লোবাল শেপার মালভিকা।

পুরো বিষয়টি শোনা যাক মালভিকার মুখ থেকে।

ভারতের তামিল নাড়ুর কুম্বাকোনামে জন্মগ্রহণ করেন মালভিকা। বাবার চাকরির সূত্রে ছোট বেলায় রাজস্থান চলে যেতে হয়। সেখানেই কেটেছে ১৩ বছর।

সে সময়ে নিজেকে ‘টমবয়’ আখ্যা দিয়ে মালভিকা বলেন, মাঠে খেল‍াধ‍ূলা, সাঁতার, স্কেটিং করাটা বেশ উপভোগ করতাম। প্রায় সাতবছর শিখেছি নাচ। দুর্ঘটনার আগের সময়টা হৈ-হুল্লোড় করে কাটতো।

২০০২ সালের ২৬ মে মালভিকার জীবনে ভয়াবহ একটি দিন।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মালভিকা বলেন, স্থানীয় একটি বিস্ফোরক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে বিস্ফোরক, গ্রেনেডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পর্দাথ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরক প্রতিবেশীর বাসায় এসে পড়ে।

‘বস্তুটিকে’ পরিত্যক্ত ভেবে তুলে নেন মালভিকা। এর মধ্যে কী রয়েছে জানার জন্য শক্ত বস্তুটি ভাঙতে চেষ্টা করেন। এরপর শক্ত একটি বস্তু দিয়ে আঘাতের পর তা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। আর তাতেই হারান দু’হাত। সৃষ্টি হয় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। দু’বছর ধরে চলতে থাকে বিভিন্ন অপারেশন। এরপর দাঁড়াতে সক্ষম হন।

মালভিকা বলেন, বিস্ফোরণের পর চারপাশে ঘটতে থাকা সবকিছু বোঝার চেষ্টা করি। যদিও শরীর নিস্তেজ। মা চিৎকার করে ‘মেরি বাচ্চি কি হাত চলি গেয়ি’ কথাটি বলছিলেন তাও শুনতে পাই বলেন মালভিকা।

তিনি বলেন, ঘটনার পর দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শরীর থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ রক্ত বের হয়ে যায়। যখন আমাকে নিয়ে সবাই হাসাপাতাল পৌঁছে তখন আমার রক্তচাপ শূন্য। বাঁচানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন চিকিৎসকরা।

দু’পায়ের মধ্যে বিশেষ করে বাম পায়ের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। শুধুমাত্র একটি চামড়ার মাধ্যমে কোনো রকমে লাগানো ছিল।

স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় কিভাবে সে দিনগুলো কেটেছিলো তা মনে পড়লে আজো আতঁকে ওঠি। হাতের কিছুই অবশিষ্ট না থাকায় ঘটনার পর চিকিৎসকরা হাত দু’টি কেটে ফেলেন। এমনকি ঘটনাস্থলেও কোনো অস্তিত্ব পাওয়‍া যায়নি।

পরবর্তীতে চামড়ার ওপর একটি অস্ত্রপচার করা হয় এবং চলাফেরা করার জন্য হাতে দু’টি লাঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকমাস ধরে চেন্নাইয়ের আন্নানগরে থেরাপি চলতে থাকে। ২০০৩ সালের নভেম্বরে প্রথম মাটিতে পা ফেলার চেষ্টা করি।

এখানেই শেষ নয়, আরো যেতে হবে। এজন্য কৃত্রিম হাতের সন্ধানে আমি ও মা চেষ্টা চালাতে থাকি। অবশেষে গুগলের শরণাপন্ন হই। একসময় কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করে অটোবক নামে জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাই। প্রতিষ্ঠানটির একটি শাখা চেন্নাইয়ে রয়েছে জানতে পেরে আশা আরো বেড়ে যায়। আর এভাবেই পেয়ে যাই এক জোড়া বায়ো-ইলেকট্রিক হাত।

ওই হাত সংযোজনের পর শুরু হয় হাতে লেখার চেষ্টা। প্রথমদিকে অক্ষরগুলো বড় হতো। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাই। ধীরে ধীরে লেখার উন্নতি হতে থাকে। তিনমাস পর পরীক্ষা। পড়াশোনায় মনযোগ দিতে বন্ধুদের সহযোগিতা নেই। স্থানীয় একটি কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর অপেক্ষা ফলাফলের। আর প্রকাশের দিন ঘটলো আরো এক বিস্ময়। গণিত ও বিজ্ঞানে ৯৭ শতাংশ নম্বরসহ রাজ্যের মেধাবীদের মধ্যে স্থান করে নেই। পরদিন সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় আমাকে নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়। সে সময় উঠে আসে দুর্ঘটনার বিষয়টিও।   

এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আব্দুল কালাম আমাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে তার সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। সাক্ষাত হয় বিভিন্ন তারকার সঙ্গে। আর উইসডম ম্যাগাজিন থেকে দেওয়া হয় ‘মডেল স্টুডেন্ট’ ৠাওয়ার্ড।

এরপর দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও সমাজ কল্যাণে মাস্টার্স সম্পন্ন করি।

পড়াশোনার কারণে মাঠে কাজ করার সুযোগ হয় আমার। সে সুবাদে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে দেখা হয়। এ সময় তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা করি।

গত বছর টিইডিএক্স টক নামে একটি অনুষ্ঠান আমাকে নিজের সর্ম্পকে বলার সুযোগ করে দেয়। যা আমার জীবনকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দেয়।

মালভিকা বলেন, অনুষ্ঠানে যখন অন্যরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন, তখন মনে হলো আমি অন্যদের চেয়ে ভালো আছি।

গত বছর ব্যাঙ্গ‍ালুরুতে একটি সামিট উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে আমি অনুধাবন করি, আমার শারীরিক অক্ষমতা আমাকে মেনে নিতে হবে।

এজন্য তিনি বন্ধু, পরিবারের সদস্যদের ‍বিশেষ করে মার কথা উল্লেখ করেন। মালভিকা বলেন, তিনি (মা) আমাকে পুরো সময়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। কেউ যেন আমাকে আঘাত না করে তা তিনি সবসময় নজরে রেখেছেন। তিনি আমাকে কখনো অন্যভাবে দেখেননি। তার সহযোগিতায় আজ আমি এখানে।  

বর্তমানে মাদ্রাজ স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কে জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে পিএইচডি করছি।

মালভিকা বলেন, একযুগ আগে যখন আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিলাম, তখন  আজকের দিনের কথা চিন্তা করতে পারিনি। জীবন ‍আসলেই অনেক সুন্দর।

কারো কোনো ধরনের সাহায্য ছাড়া এখন আমি ৯০ শতাংশ কাজ করতে পারি। তবে দৌঁড়াতে পারিনা। আর হাঁটতে গেল কিছুটা সমস্যা অনুভব করি।

নাচ আমার প্রথম ভালোবাসা। তবে জানি, আমি আর আগের মতো নাচতে পারবোনা। তারপরও নাচতে শুরু করেছি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জীবনের এখনো অনেক কিছু বাকি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।