ঢাকা: ‘আমাদের গাড়ির কাছে যখন আমরা গেলাম, বাতাক্লঁ থেকে মানুষ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসছিলো। তাদের অনেকেই ছিলেন রক্তস্নাত।
কথাগুলো বলছিলেন বাতাক্লঁ থিয়েটার হল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ক্যাটেরিনা গিয়ার্দিনো। জাতীয়তায় ইটালিয়ান এই প্যারিসবাসী যে সময়টার বর্ণনা করছিলেন, ততোক্ষণে থিয়েটার হলে জিম্মিদের শতাধিক নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসীদের হাতে।
শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) দিনগত রাতে বাতাক্লঁ থিয়েটার হল ও স্তেদে দ্য ফ্রান্স স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকাসহ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ও এর আশেপাশের এলাকায় ছয়টি পৃথক হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।
স্তেদে দ্য ফ্রান্স স্টেডিয়ামে তখন চলছে স্বাগতিকদের সঙ্গে জার্মান ফুটবল টিমের প্রীতি ম্যাচ। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ দর্শকসারীতে। স্থানীয় সময় ঠিক রাত ৯টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ২টা ১৭ মিনিটে) প্রথম বিস্ফোরণের শব্দটি শোনা যায়। এর পরপরই দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে।
বাতাক্লঁ থিয়েটার হল
১৯ শতকের থিয়েটার হল বাতাক্লঁ থেকে বিশ্বখ্যাত আইফেল টাওয়ারের দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার। সড়কপথে বিভিন্ন রুটে এ দূরত্বে খানিকটা কম বেশি হতে পারে। বিখ্যাত লা মেরিডিয়ান হোটেল ও হায়াত রিজেন্সিও এই এলাকাতেই অবস্থিত।
বাতাক্লঁয়ে তখন চলছিলো রক কনসার্ট। ক্যালিফর্নিয়াভিত্তিক রক ব্যান্ড ‘ইগলস অব ডেথ মেটাল’ মঞ্চে। নিজেদের চতুর্থ অ্যালবামের প্রচারণায় ব্যস্ত তারা। আর উপস্থিত দর্শক ব্যস্ত তাদের পারফরমেন্স দেখায়। কারোর মনেই তখন সন্ত্রাসী হামলার বিন্দুমাত্র শঙ্কা নেই। হঠাৎই যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেল।
হামলায় বেঁচে যাওয়াদের একজন সাংবাদিক জুলিয়ান পিয়ার্স। ঘটনা শুরুর পরপরই তিনি মঞ্চের পাশে আত্মগোপন করেন। পরে সেখান থেকে বাইরে বের হওয়ার পথ খুঁজে পেলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
পরবর্তীতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি পেছন দিকে ঘুরে কালো পোশাকে একজনকে দেখলাম। খুবই অল্প বয়স তার। বড়জোর ২০ বছর হবে। প্রথমের ঘটনাপ্রবাহ প্রদর্শনীর অংশ বলেই মনে হচ্ছিলো আমার। কিন্তু ভুল ভাঙতেও বেশি দেরি হলো না। যুবকের হাতের রাইফেলের ব্যারেল থেকে অগ্নিবর্ষণ হতেই বুঝলাম, এটা মোটেই কোনো কৌতুক নয়।
থিয়েটার হলের সামনে দিয়ে ঘটনার সময় হেঁটে যাওয়া ২২ বছর বয়সী যুবক তুন বলেন, সার্কাসে যেভাবে মানুষ লাফায়, সেভাবেই যেন হলের দর্শকরা ছটফট করছিলো। গুলির সময় হামলাকারীদের একজনকে মাথায় বড় হ্যাট পরা অবস্থায় দেখেছি আমি। তাদের সবার পোশাক ছিলো কালো।
অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, হামলাকারীরা হলে উপস্থিত সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বাধ্য করে। তারপর যেন তাদের ওপর বুলেটের বৃষ্টি বর্ষিত হলো। যারা পালাতে চেষ্টা করছিলো, তাদেরকেও ছাড় দেওয়া হলো না।
স্থানীয় একটি রেডিও’র উপস্থাপক পিয়েরে জানাসজাক তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, সব জায়গায় রক্ত আর মাংসপিণ্ডের ছড়াছড়ি। আমরা চিৎকার শুনতে পেলাম। সবাই পালানোর চেষ্টা করছিলো।
লাগাতার গুলিবর্ষণ
সাধারণত প্যারিস সবসময়ই জনবহুল। স্থানীয় ও দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে এই শহর। আর তা যদি হয় শুক্রবার রাত, তাহলে তো কথাই নেই। বাতাক্লঁ থিয়েটার হলের পাশাপাশি ১৩ নভেম্বর দিনগত রাতে পেতিত ক্যামবজ কম্বোডিয়ান রেস্টুরেন্ট এবং দ্য ক্যারিলন বারেও হামলা চালায় বন্দুকধারীরা।
বার ও রেস্টুরেন্টের কাছেই বাস করেন পিয়েরে মন্টফোর্ট। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আমরা হঠাৎই গুলির আওয়াজ পেলাম। টানা ত্রিশ সেকেণ্ড শোনা গেল এই আওয়াজ। মনে হচ্ছিলো, এর কোনো শেষ নেই। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, কেউ আতশবাজি ফাটাচ্ছে।
অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী ফ্লোরেন্স জানিয়েছেন, মুহূর্তের জন্য আমরা শুধু অগ্নিস্ফূলিঙ্গই দেখতে পেলাম। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো। এ যেন কোনো পরাবাস্তব ঘটনা। সবাই তখন মাটিতে শুয়ে। পেতিত ক্যামবজ কম্বোডিয়ান রেস্টুরেন্ট এবং দ্য ক্যারিলন বারে থাকা কেউ তখন নড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, গুলির পরপরই নিরবতা নেমে এলো। সব শান্ত হয়ে গেল। মানুষ বুঝতে পারছিলো না, কি ঘটছে। এক লোক এক বালিকাকে কাঁধে করে বেরিয়ে এলো। খুব সম্ভবত সে মারা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
আরএইচ