ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

জলের বদলে ছেলে বিসর্জন!

কল্লোল কর্মকার, আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১১
জলের বদলে ছেলে বিসর্জন!

দাবাব: তপ্ত মরুভূমির মধ্য দিয়ে ছোট দুটি সন্তান নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে হাঁটছেন এক মা। দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচতেই তিনি সন্তানদের নিয়ে ছুটছেন শরণার্থী শিবিরের পথে।

কাছে পান করার মতো যতটুকু পানি ছিল তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে বাকি আছে আরও দীর্ঘ পথ।

এমন অবস্থায় রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লো চার বছরের ছেলে। অসুস্থ ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে তার মাথায় পানি ঢালতে হবে। কিন্তু যেটুকু পানি আছে তা ছেলের মাথয় ঢাললে বাঁকি পথ চলতে গিয়ে তৃষ্ণায় মারা যাবে কোলের এক বছরের মেয়েটি। এমন অবস্থায় কী করতে পারেন ওই মা? ছেলেকে বাঁচাবেন নাকি মেয়েকে? তাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, কোন সন্তানকে তিনি বাঁচাবেন।

করুণ এ কাহিনী সোমালিয়ার এক মায়ের। এক বছরের মেয়ে আর চার বছরের ছেলেকে নিয়ে মা ওয়ার্দো মাহমুদ ইউসুফ দুই সপ্তাহ ধরে হাঁটছেন দাবাব শরণার্থী শিবিরের পথে। সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষ থেকে প্রাণ বাঁচাতেই তার এই ছুটে চলা।

দীর্ঘ যাত্রার শেষ পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো তার চার বছরের ছেলে। ওয়ার্দো ভাবলেন, ছেলের মাথায় একটু পানি ঢাললে হয়তোবা সে সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু তার কাছে আছে অল্প একটু খাবার পানি। সেই পানি দিয়ে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। না হলে মারা যাবে কোলের সন্তান।
 
এ মুহূর্তে তিনি সফরসঙ্গী অন্য পরিবারগুলোর কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু কেউই তার কথা শুনে থামল না তাকে সাহায্য করার জন্য। যাদের কাছে ওয়ার্দো সাহায্য চাইলেন তারাও তারই মতো দীর্ঘ যাত্রায় নেমেছেন জীবন বাঁচাতে। তারা সবাই নিজেদের টিকিয়ে রাখা নিয়েই চিন্তিত।

এমন সঙ্কটময় আর উপায়হীন পরিস্থিতিতে ২৯ বছর বয়সী এই মাকে এমন এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো যা কোনোদিন কোনো বাবা-মা নিতে পারে না।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দাবাব শরণার্থী শিবিরে কোনোমতে পৌঁছতে পারা ওয়ার্দো নিজেই জানান তার জীবনের এই করুণ কাহিনী। তিনি বলেন, ‘শেষমেষ বুকে পাথর বেঁধে আমার অসুস্থ সন্তানকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে এলাম।

তবে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, সে বেঁচে আছে। এটা আমার মন বলছে। ’

চলতি দুর্ভিক্ষ এমন নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে অনেক সোমালী বাবা-মাকে।

সোমালিয়া থেকে দাবাব শরণার্থী শিবিরের দূরত্ব অনেক। এতোটা পথ একটু পানির জোরে আসা এক কথায় অসম্ভব। আর তাই পথে অসুস্থ হয়ে যাওয়া সন্তানকে আল্লাহর ভরসায় পথেই রেখে আসতে হয় অনেক সময়।

ওয়ার্দো বলেন, ‘আমার জীবনে এমন উভয় সঙ্কটের মধ্যে পড়িনি। এখন আমি সন্তান হারানোর কষ্ট বোধ করছি। রাতের বেলা ছেলেকে স্বপ্নে দেখি। ঘুম ভেঙে যায়। ওর বয়সী কোনো বাচ্চাকে দেখলে আমি আঁতকে উঠি। ’

দাবাব শরণার্থী শিবিরে আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী দলের মানসিক ডাক্তার জন কিভেলেঞ্জ বলেন, ‘বড় কোনো মানসিক ধাক্কা পরবর্তী সময়ে এমন হয়। এটা একটা সাধারণ প্রতিক্রিয়া। ’
 
তারা ভাবতে শুরু করে, যে সন্তানটিকে তারা ছেড়ে চলে আসছে সেই সন্তানটিই ফিরে এসে তাদের হত্যা করছে। তাদের ঘুম হয় না বলেও জানান ডাক্তার জন কিভেলেঞ্জ।
 
এদিকে জতিসংঘ দাবি করছে, সোমালিয়ায় গত তিন মাসে পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন ২৯ হাজার শিশু দুর্ভিক্ষের কারণে মারা গেছে। অগনিত শিশু দুর্বল এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। তারা দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে পারে না এমনকি ভালো করে কথাও বলতে পারে না।

২৯ বছর বয়সী বিধবা ফাদুমা সাখো আবদুল্লাহি। তিনি তার চার সন্তানকে নিয়ে দাবাব শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। দাবাবে পৌঁছার একদিন আগেই তার ৪ বছরের কন্যা শিশু এবং ৫ বছরের ছেলে সন্তান মারা যায়।
আবদুল্লাহি বলেন, ‘আমার কাছে অল্প একটু পানি ছিল খাবার জন্য। আমি সেই পানি অপচয় করতে চাইনি। আমি জানতাম না সামনের পথ আর কতদূর। তাই আমি ওদের পানি দিতে পারিনি। দুই সন্তানকে রাস্তার পাশের গাছ তলায় ফেলে রেখে আসতে হয়েছে। ’
 
দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় পূর্ব আফ্রিকার এক কোটি ২০ লাখ মানুষের খাবার দরকার। জাতিসংঘ বলছে, ৩০ লাখ মানুষের এই মুহূর্তেই খাবার দরকার, না হলে তাদের জীবন বাঁচানো কষ্টকর হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।