ঢাকা: দীর্ঘ ২০ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরায় তৃতীয়বারের মতো দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে “হর্ণ অফ আফ্রিকা”র অর্ভূক্ত দেশ হিশেবে পরিচিত সোমালিয়া। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে অনাহারে, অপুষ্টিতে প্রতিদিন মরছে শিশু, নারী, পুরুষ।
১৯৯১ সালে প্রেসিডেন্ট বারির ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে সোমালিয়ায় রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু। উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল বাহিনীর হাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এ দুই বাহিনীকে ইথিওপিয়া অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। এরপর আলি মাদি মুহম্মদকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। তবে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেক গ্রুপই মেনে নিতে পারেনি। এদিকে বারি তখনো নিজেকে সে দেশের বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবি করে আসছিল। তার সশস্ত্র সমর্থকরা দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে সহিংসতা শুরু করে। এ সময় এ অঞ্চলের কিছু এলাকায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটি।
চলমান গৃহযুদ্ধে সোমালিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। এখানে অধিকাংশ সংঘর্ষ ঘটে গোত্রের প্রতি আনুগত্য থেকে এবং বিবাদমান গোত্রগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার কারণে। সোমালিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন জেমস বিশপ, তিনি এ সংঘর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এখানে পানি, গবাদিপশু, গোচারণক্ষেত্রের মতো অনেককিছু অধিকারে পেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তারা তীর, তলোয়ার নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এখন তীর, তলোয়ারের জায়গায় এসেছে একে-৪৭। আর এর ফলে দুর্ভিক্ষে এখনো পর্য সেখানে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া দেশটিতে আল-শাবাব, হিজবুল ইসলাম, আহলু সুন্নাহ অলজামার মতো কয়েকটি গেরিলা সংগঠন সক্রিয়। আছে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের লোলুপ দৃষ্টি।
সোমালিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ভেতর নিচু সাবেলি, মধ্য এবং নিচু জিওবা, বে , বাকুল, বিনাদির, জিদো এবং হিরাণ এলাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। খরা উপদ্রুত এলাকায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে আল শাবাব গেরিলা গোষ্ঠীর কারণে। ২০০৯ সাল থেকে তাদের নিয়ন্ত্রনে থাকা অঞ্চলে দাতাগোষ্ঠীকে ত্রাণ তৎপরতা চালাতে দিচ্ছে না।
সোমালিয়ার বর্তমান দুর্ভিক্ষকে তুলনা করা হয়েছে ২০০৫ সালের নাইজার, ২০০১ সালের ইথিওপিয়া, ১৯৯৮ সালে সুদান এবং ১৯৯২ সালে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের সঙ্গে। যদিও ১৯৯১ সালে সোমালিয়া দুর্ভিক্ষের পর থেকে আফ্রিকায় খাদ্য সংকট অব্যাহত রয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্য মোগাদিসুর সাড়ে চার লাখ মানুষকে প্রতিমাসে মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলো খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্য দক্ষিণ সোমালিয়ার ৪১৮টি পুষ্টি কেন্দ্র থেকে প্রায় দেড় লাখ শিশুকে অপুষ্টি প্রতিরোধক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে, খরাকবলিত সোমালিয়ার বিভিন্ন প্রা থেকে প্রায় সোয়া লাখ গণমানুষ পালিয়ে এসে রাজধানী মোগাদিসুতে আশ্রয় নিয়েছে। লোকে সাধারণত সংঘাতকবলিত এলাকা এড়িয়ে চলে। কিন্তু এখানে ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষকবলিত এলাকার ক্ষুধার্ত মানুষ মরিয়া হয়ে খাবারের সন্ধানে ছুটছে রাজধানী মোগাদিসুর দিকে। তাদের আশা, হয়তো সেখানে গেলে কিছু খাবার জুটবে।
জাতিসংঘের হিসাবমতে, দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমানে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে, যখন দেশটির প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ লোক দুর্ভিক্ষের হুমকির মধ্যে রয়েছে। দেশটির কয়েকটি এলাকায় প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে প্রতিদিন অত ৪ জন মারা যাচ্ছে। যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। জাতিসংঘের হিসাবে, এ মৃত্যুর হার দেশটির তিনটি দুর্ভিক্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অন্য দুটি দুর্ভিক্ষে প্রতি ১০ হাজারে প্রতিদিন ৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আমেরিকার কর্মকর্তারা এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, গত ৯০ দিনে দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় ৩৬ হাজার শিশু মারা গেছে।
জাতিসংঘ সোমালিয়ার তিনটি এলাকাকে দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণা করেছে। তবে ৫টি অঞ্চল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। গত মাস থেকে নতুন আরো দুটি এলাকা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাড়ে ৫ লাখ লোক দুর্ভিক্ষ এলাকার মধ্যে বসবাস করছে।
আমেরিকাজানিয়েছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরো দক্ষিণ সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে।
ইউনাইটেড স্টেটস-ফান্ডেড ফেমাইন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমস নামের প্রতিষ্ঠানটি গত বছর কমপক্ষে ছয়বার বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে জানায়, পূর্ব আফ্রিকায় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তখন সবাই ওই সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করল। এরপর যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনাহারী মানুষগুলোর ছবি আসা শুরু করলো তখন সবাই বুঝল সোমালিয়ার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে। একটা ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অথচ আগে থেকে পদক্ষেপ নেয়া হলে এড়ানো যেত বহু মানুষের মৃত্যু।
আগামী দুই মাস খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ। এর মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাবে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষপীড়িত অধিকাংশ মানুষের ভবিষ্যৎ। অনাহার থেকে বাঁচাতে চাইলে এ সময়ের মধ্যেই নিতে হবে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা। উচিত হলো, প্রথমেই সোমালিয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট (আরটুপি) বিধি জারি করা। যে পরিস্থিতিতে বিধিটি প্রয়োগ করা যায়, তার উভয় কারণ এরই মধ্যে সোমালিয়ায় উপস্থিত রয়েছে। দেশ রক্ষায় অভ্যন্তরীণ শক্তির ইচ্ছা ও যোগ্যতার অভাব রয়েছে সেখানে। সোমালিয়ার সরকার পারছে না জনগণকে রক্ষা করতে। অন্যদিকে নিজের এলাকায় অনেক ত্রাণ সংস্থাকে কাজ করতে দেয়ার ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছে আলশাবাব। এ অবস্থায় আরটুপি বিধি প্রয়োগ না করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। নিরাপত্তা পরিষদের দ্রুত এ উদ্যোগ নেয়া দরকার।
আরেকটি বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ত্রাণ সংস্থার ব্যাপারে শিথিল নীতি গ্রহণ করা, কমপক্ষে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে। ওয়াশিংটন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আলশাবাব নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখার। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের উচিত হবে, ত্রাণ সংস্থাগুলোকে তাদের মতো কাজ করতে দেয়া। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে স্থানে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন, সেখানে বিমান থেকে খাদ্যসামগ্রী দেয়া আবার শুরু করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা। মিডিয়ায় যেসব ছবি দেখানো হয়েছে তার অধিকাংশই মোগাদিসু ও দাদাব এলাকা থেকে তোলা। দুর্গম এলাকায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সামনে তেমন আসেনি। আশঙ্কা রয়েছে, সেখানকার অবস্থা আরও বেশি খারাপ। এ ছাড়া প্রমাণ রয়েছে, অনেকে কাছের শহর ও লঙ্গরখানায় পৌঁছাতে পারছেন না।
ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আরেকটি উপায় হতে পারে, স্থানীয় বিভিন্ন সাহায্য সংগঠনকে কাজে লাগানো। এতে ছোট শহর ও প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব হবে। স্থানীয় বিভিন্ন বিষয়ে এ সংস্থাগুলোর অভিজ্ঞতা বেশি। এ ক্ষেত্রে মানি ট্রান্সফার এজেন্সিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশব্যাপী এদের শাখা রয়েছে। তারা দূরবর্তী অঞ্চলে সহজে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দিতে সক্ষম। ইতিবাচক বিষয়টি হলো, এ সংকটে সোমালিয়ার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের ঐক্য ও নেতৃত্ব দেখাতে পেরেছে। সংকট কাটাতে দাতাদের মধ্যেও সাড়া জাগানো গেছে। সাতজন সোমালি ক্যালগারি থেকে হেঁটে অ্যাডমন্টন গিয়েছিলেন, দুর্ভিক্ষের জন্য ফান্ড ও সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। তাদের আহ্বান শুনেছেন অনেকেই। এ উদাহরণ অন্যদের উৎসাহী করবে।
উন্নয়ন ধারার এ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে অংশীদারিত্বের নীতির মূল কথা। এর মধ্যে আছে সর্বজনীনভাবে গৃহীত নৈতিক মূল্যবোধ যা আমাদের সাধারণ মানবতারই প্রতিফলন ঘটায়। আমাদের অংশীদারী নৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আর্জাতিক নীতির আলোচনা হলে তা দশকের পর দশক ধরে চলমান অন্যায় আর্থিক ও সামাজিক নীতির পুনর্মূল্যায়নে সহায়ক হবে, ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটাবে এবং অগ্রগতি ও উন্নয়নের একটা একক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দৃশ্যমান হবে।
সাধারণভাবে অর্থনৈতিক ভাষায় বলা যায়, অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো ধনী দেশ থেকে দরিদ্র দেশে সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের চেয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের স্বার্থে। পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর সংকট সুশীল সমাজের অনুকূলে এমন দাবি করার আরো একটা সুযোগ এসেছে যে, সারা বিশ্বে অর্থ ও সম্পদ বণ্টন করতে হবে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে এবং নীতিনির্ধারকদের অন্য সবধরনের বিষয়ের চেয়ে পুরোপুরি দারিদ্র্য নির্মূলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বর্তমানের মূল বিষয় হলো, যথাযথ ত্রাণ সহায়তা দিয়ে বর্তমান দুর্ভিক্ষের আকাল দূর করা। কিন্তু, ভবিষ্যতে যেন এমনটি আর না হয় সেজন্যে ভবিষ্যতের দূরদর্শী সিদ্ধারে মাধ্যমে দারিদ্রতা নির্মূলকরণের পরিকল্পনা অবশম্ভাবী। সে ক্ষেত্রে সোমালিয়ায় শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
লেখক: কবি , কলামিস্ট, বিশ্লেষক ও গবেষক।
ইমেইলঃ[email protected]