ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

মানবপাচার: আধুনিক দাসত্বের মহামারী

কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১১
মানবপাচার: আধুনিক দাসত্বের মহামারী

ঢাকা: প্রথম বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১২। সেই বয়সেই বাবার বয়সী এক লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল।

আমাদের খাওয়ার মতো কিছুই মিলতো না। আমি শুনতাম, মানুষ বিয়ের পর সুখী হয়। স্ত্রীরা খেতে পায়। কিন্তু আমি তার কিছুই দেখিনি। বিয়ের পাঁচ মাস পর স্বামী আমাকে তালাক দেয়। তখন বাবা আমাকে তার কাছে রাখেন। কিন্তু তিনি আমাকে খেতে দিতে পারতেন না।
 
একদিন আমি মাঠে গেলাম খাওয়ার জন্য কিছু লতা-পাতা সংগ্রহ করতে। সেখানে দেখা হয় প্রতিবেশি ফাতিমার সঙ্গে। ফাতিমাকেও তার স্বামী তালাক দিয়েছে। সে আমাকে বললো, তার সঙ্গে গেলে অনেক খাবার মিলবে, অনেক কাজও পাওয়া যাবে। এর একদিন পরেই আমি কাউকে কিছু না বলে তার সঙ্গে রওয়ানা দেই। আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। ফাতিমা আমাকে নিজের টাকা দিয়ে খাওয়াতো। আমার ঠিক মনে নেই, কোন রাস্তা দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম।

তবে হাওড়া স্টেশনে আয়মনি নামের একজনের কাছে আমাকে তুলে দিয়ে ফাতিমা অন্য কোথাও চলে যায়। আয়মনি হাওড়া স্টেশনের কাছেই থাকতো। আমি আয়মনির কাছে তিন দিন ছিলাম। এরপর সে আমাকে উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে নিয়ে যায়। রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল হেঁটে আমরা সেখানে পৌঁছাই। সেখানে তিনি শম্ভু পাল নামের একজনের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলে চলে যাওয়ার সময় আয়মনি আমাকে বলে, আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। এই কথা শুনে আমার পায়ের মাটি কেঁপে উঠলো। আমি তখনই পালাতে চাইলাম। কিন্তু শম্ভু পাল আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলো। পরে আমি বুঝতে পারলাম, আয়মনি আমাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে।

এক সপ্তাহ আমি বন্দী ছিলাম ওই ঘরে। কিছুদিন পরে শম্ভুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর থেকেই শম্ভু আমাকে মারধোর করতো। এভাবে তিন বছর ধরে আমাকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করেছে শম্ভু।

এই গল্প বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের আমিনা নামের পাচার হওয়া এক মেয়ের। শেষমেষ একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় আমিনা ওই কারাগার থেকে মুক্তি পায়। এমন অনেক আমিনা প্রতিবছর বিভিন্নভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। কিন্তু সবার ভাগ্য শেষমেষ আমিনার মতো হয় না।

আধুনিক দাসপ্রথার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মানবপাচার। নানা দেশ থেকে অর্থের লোভে, ছলনার শিকার হয়ে বা অপহরণের শিকার হয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯৯৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই এই ইস্যুটি মারাত্মক আকার ধারন করে বিশ্বব্যাপী। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এই মানবপাচারের বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরেই কাজ করছে।  
Data
মানবপাচার সম্পর্কে আইএলওর (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) মহাপরিচালক জুয়ান সোমাভিয়া জানান, দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দার ফলে দিন দিন মানবপাচার বাড়ছেই, যা এক অর্থে গভীর উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বব্যাপী নতুন এক দাসত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। পাচারকারীদের মাঝে মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু মাদক চোরাচালানিদের তুলনায় তাদের শাস্তি অনেক কম হয়।

মানবপাচারকে মহামারী আখ্যা দিয়ে আইএলও আরও জানায়, এই মহামারী রোধ করতে উন্নত বিশ্বকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।

বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রে যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় ১২-১৪ বছর বয়সী অনেক মেয়েকেই দেখা যায় যৌনপেশায়। বেশিরভাগ শিশুই পার্শ্ববর্তী উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার থেকে সাড়ে ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

বিশ্বের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এই মানবপাচারের ঘটনা ঘটে বেশি। এসব অঞ্চলের দেশগুলো হচ্ছে- বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলসমূহ, ইথিয়েপিয়া, বেলারুস, তুরস্ক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, পেরু, বলিভিয়া, অফ্রিকার দক্ষিাণাঞ্চলীয় দেশগুলো, দক্ষিণ অফ্রিকা, বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি ও পাকিস্তান। সারাবিশ্বে মানবপাচারের হার দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এবং সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবপাচার।

২০০৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত মানবপাচার বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে নর-নারীসহ শিশু পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশে থেকে একই সঙ্গে মানবপাচার হয় এবং এশিয়ায় মানবপাচারের অন্যতম রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয় দেশটি। বাংলাদেশ থেকে ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই বাণিজ্যিকভাবে যৌন কাজে লাগানোর জন্য পাচার করা হয়। দেশটির দারিদ্রতা এবং দুর্বল অবকাঠামোই এর মূল কারণ। বাংলাদেশের দরিদ্র নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানে যৌনপেশায় লাগানোর জন্য পাচার করা হয়ে থাকে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, বাহারাইন, কুয়েত, দুবাই, ইরাকেও নিয়মিত পাচার হয় বাংলাদেশি নারীরা।
   
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানিতে প্রায় ৭০০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করে। বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বিএআইআরএ) আওতায় ওই এজেন্সিগুলো কাজ করে। বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএআইআরএর নির্ধারিত চার্জ হলো এক হাজার ২৩৫ ডলার। কিন্তু বেশিরভাগ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই রেটের চেয়ে বেশি পরিমান অর্থ দাবি করে বিদেশে গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে। ফলে তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য বিকল্প পথের সন্ধান করতে গিয়েই পাচারকারীদের প্রলোভনে পা দেয়।
 
বিভিন্ন এনজিওর রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে চাওয়া মানুষরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হয়। দেশ থেকে একজন নারীকে বাসা-বাড়িতে কাজ করতে দেওয়া হবে বলে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কোনো এক যৌনপল্লীতে।
 
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ সরকার সার্বিকভাবে মানবপাচার বিরোধী আইন পাশ করে। বিশেষ করে নারী এবং শিশুদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছরের নিচে কোনো শিশুকে যৌনপেশায় নিয়োজিত করলে তা দণ্ডবিধির ৩৭২ এবং ৩৭৩ অনুচ্ছেদ (নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০ এর সংশোধনী ২০০৩) অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে। শাস্তির মধ্যে রয়েছে সর্বনিম্ন ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান।

তবে আইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে মানবপাচার বিরোধী কার্যক্রম। মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা কার্যকরী পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। পাচার হতে গিয়ে ধরা পড়া মানুষদের ব্যাপারে নেই সরকারের কোনো আশ্রয় কেন্দ্র। এছাড়া দণ্ডবিধির মধ্যে রয়েছে নানা সমস্যা। ৩৬৪-এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১০ বছরের নিচে কাউকে অপহরণ করলে অথবা বাধ্যতামূলকভাবে কাজে লাগালে সর্বনিম্ন ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ মৃতুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। আবার ৩৬৬-এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকে অপহরণ বা জোরপূর্বক যৌন পেশায় নিযুক্ত করলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।

একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মতে, মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হওয়া বাংলাদেশি মেয়েদের কদর অনেক বেশি। একটু দেখতে সুন্দর ও স্বাস্থ্য ভালো মেয়েদের দাম হয় কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর শিশুরা বিক্রি হয় সাত থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্র দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যায় অনেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শিশুদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

মাদক এবং অস্ত্র বাণিজ্যের পর সবচেয়ে রমরমা বাণিজ্য হলো মানবপাচার। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয় মানবপাচার নিয়ে। পাচারকৃত মানুষদের বেশিরভাগকেই হয়তো জোরকরে কাজ করানো হয় অথবা যৌনকাজে লাগানো হয়। এমনকি অনেককে বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গেও লিপ্ত করা হয়।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের এক হিসাব মতে, প্রতিবছর সাত লাখ থেকে চল্লিশ লাখ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পাচারের শিকার হয়।

কিন্তু আইওএম-এর মুখপাত্র জেন ফিলিপ্পি বলেন, ‘মানবপাচার ব্যবসার গোপনীয়তার কারণে সঠিক করে জানা সম্ভব নয় কত সংখ্যক মানুষ প্রতিবছর বিশ্বব্যপী পাচারের শিকার হয়। ’
 bangladesh
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম শোষণ অথবা যৌনপেশা মানবপাচারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বিশ্বব্যাপী এটা একটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একটা অঞ্চল পাওয়া যাবে না, যে অঞ্চলটি মানবপাচারের কালো থাবার বাইরে আছে। একটু ভালো খাওয়া আর একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে লাখ লাখ নারী-পুরুষ এবং শিশু তাদের বাড়ি ত্যাগ করে। ’
 
যৌনপেশা আজ বিশ্বের এক ভয়াবহ সমস্যার নাম। নানা দেশের নাম না জানা লাখ লাখ মেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাড়ি জমায় অন্ধকার গলিতে। তেমনি এক নারী ভেনেজুয়েলার কিক্কা ছেরপা। প্রেমের ছলনায় আর একটু ভালো থাকার প্রলোভনে নিজ দেশ ছেড়ে ১৯৯২ সালে প্রেমিকের সঙ্গে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু যার হাত ধরে তিনি দেশ ছাড়েন, সেই প্রেমিকই তাকে বিক্রি করে দেয় এক যৌনাপল্লীতে।

তার জীবনের সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটু ভালো থাকার আশায় আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। কথা ছিল সেখানে আমি আয়ার কাজ করবো। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার যৌনপল্লীতে গিয়ে শেষ হয়। তিন বছর ধরে প্রতিদিনই আমাকে ধর্ষণ আর শারিরীক নির্যাতন করা হতো। ’

একজন খদ্দেরের চেষ্টায় শেষমেষ যৌনপল্লী থেকে মুক্তি পান কিক্কা। কিন্তু ভাগ্য তার প্রতি তখনও সদয় হয়নি। সেই খদ্দের তাকে তার ব্যক্তিগত দাসী বানিয়ে রাখে। দশ বছর ধরে তাকে থাকতে হয় সেই খদ্দেরের কাছে। সে সময় তার দুটি কন্যা সন্তান জন্মায়।

কিক্কা আরও বলেন, ‘আমি প্রায়ই পালাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমি পালালে সে আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে এবং আমাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবে। আমি আমার সন্তানদের কথা চিন্তা করে আর পালাতে পারিনি। ’
 
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৫ হাজার নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্সের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার শিশু পাচারের প্রধান দুই উৎস দেশ হলো বাংলাদেশ এবং নেপাল। এক হিসাবে দেখা যায়, ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে বাংলাদেশেরই প্রায় ২৭ হাজার নারী যৌনপেশায় আছেন।
 
গত দশকে দুই লাখ বাংলাদেশি মেয়েকে পাকিস্তান, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে দুই শ’ থেকে চার শ’ নারী ও শিশু পাচার হয়। এদের বেশিরভাগই যায় পাকিস্তানে। এছাড়া প্রতিদিন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৫০ জন নারী ও শিশু কোনো না কোনোভাবে পাচার হয়।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দিয়েই মূলত মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেশিরভাগ পাচারকৃত নারী-পুরুষ ও শিশুকে দিনাজপুর এবং কক্সবাজার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মেয়েদের পাচার করা হয় উত্তরাঞ্চলের সীমান্তগুলো দিয়ে।

কুষ্টিয়া অঞ্চলের কিছু এলাকাও পাচারকারীরা ব্যবহার করে। রাজশাহীর বিদিরপুর এবং প্রেমতলী সীমান্ত দিয়ে বেশি মানবপাচার হয়। কারণ এই দুই সীমান্তে নেই তেমন কোনো তল্লাশি চৌকি।

মানবপাচারকারীদের কাছে যশোর সীমান্ত অনেক বেশি জনপ্রিয়। এখানকার কিছু কিছু হোটেল এবং গোডাউন ব্যবহার হয় শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরে আনা মেয়েদের রাখার জন্য। এখানে প্রতিদিন অন্তত ১৩ জন নারী পাচার হয়। সাতক্ষীরা, যশোর, সিলেট এবং চট্টগ্রাম দিয়েই সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হয়। পাচারকারীরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ১৬টি জেলার ২০টি প্রধান পয়েন্ট ব্যবহার করে থাকে। মূল পাচারকারী রুট হলো ঢাকা-মুম্বাই-করাচি-দুবাই। বেশিরভাগকেই পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে মানবপাচারের একটি উৎস দেশ এবং পাচার রুট হলো হাঙ্গেরি। মূলত হাঙ্গেরির নারীদের জোরপূর্বক যৌনপেশায় নিয়োজিত করা হয়। হাঙ্গেরির মেয়েদের পাচার করে নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। এছাড়াও রুমানিয়া এবং ইউক্রেনের পাচার করা মেয়েদের হাঙ্গেরি হয়ে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
 
মানবপাচারের ট্রানজিট দেশগুলোর মধ্যে আরও একটা হলো আফগানিস্তান। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নারী, পুরুষ ও শিশুদের এদেশের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাচার করা হয়। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে বিভিন্ন গ্রুপ বেশ সক্রিয়ভাবে এখানে কাজ করে মানবপাচারে। এছাড়া আফগানিস্তানে মাদকের ব্যপকতার কারণে দেশটির পুরুষ এবং ছেলেদের বাধ্যতামূলক মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। এছাড়া আফগানিস্তানের পুরুষদের পাচার করে ইরান, পাকিস্তান, গ্রিস ও আরব দেশগুলোতে কৃষি কাজের জন্যও পাঠানো হয়।

বেলারুসও মানবপাচারের আরেকটি রুট। রুট ছাড়াও বেলারুসের নারীদের পাচার করে বিভিন্ন দেশে জোর করে যৌনপেশায় নিয়োজিত করা হয়। রাশিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে বেলারুসের নারীদের পাঠানো হয়।

বেলারুসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে বলা হয়, বেকারত্বের কারণে এদেশের ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
 
অফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে মানবপাচার ও পাচারের রুট হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। এরপরই আছে নাইজেরিয়া। অফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের এই দেশের মধ্য দিয়েই অন্য দেশে পাচার করা হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু যৌনকর্মীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখানকার নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আয়ারল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে গৃহস্থালি কাজের জন্য পাচার হয়। আর অন্যদিকে মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে এবং মালয় থেকে পাচার হওয়া বয়সে তরুণ ছেলেরা দক্ষিণ অফ্রিকায় কৃষি কাজে নিয়োজিত করা হয়।

বিশ্বব্যাপী মানবপাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গত জুলাই মাসের ১৩ তারিখ মানবপাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মেক্সিকো সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ‘Don`t Be Fooled’ শিরোনামে নাটক সম্প্রচার করা হচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেও এ বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।