ঢাকা: আজ ১০ বছর পুর্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রে টুইনটাওয়ার হামলার। ২০০১ সালের ওই হামলায় প্রান হারায় অনেক মানুষ আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পরে যুক্তরাষ্ট্র।
৯/১১ এবং ইরাক ইস্যুতে বলার মতো অনেক কিছুই হয়তো আছে। কিন্তু এই বিষয়ে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জো উইলসনের অনেক কিছুই বলার আছে। তিনিই সর্বশেষ কূটনীতিক যিনি উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেসময় তিনি বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং সাদ্দাম হোসেনের কর্মকান্ডের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে কাজ করেন। ওইসময় সাদ্দাম হোসেন নির্দেশিত এক বার্তায় বলা হয়, ‘কেউ যদি বিদেশিদের আশ্রয় প্রদান করে তাহলে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে। ’ তখন ইরাকে প্রায় কয়েকশত মার্কিন নাগরিক ছিলো মার্কিন দূতাবাসের আওতাধীন।
সেই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে একটি গোপন সংবাদ সম্মেলনে জো উইলসন বলেন, ‘যদি এমন হতো যে আমেরিকার নাগরিকদের ব্যাপারে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। তাহলে আমি নিজেকেই ফাঁসির রশিতে সপে দিতাম তাও কোনো আমেরিকার নাগরিককে তার হতে তুলে দিতাম না। ’
কিন্তু তখন নিরাপদেই মার্কিন নাগরিকরা ইরাক ত্যাগ করতে পেরেছিল।
সাদ্দাম হোসেনের মুখোমুখি হওয়ার এক দশক পর উইলসন নিজ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও দাড়ান। আর ওই ইস্যুটি ছিল আসলেই ভয়াবহ। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে জর্জ ডব্লিউ বুশ এক বিবৃতি প্রদান করেন। আর ওই বিবৃতিকে নিয়েই বিরোধিতা করেন জো উইলিয়াম। বিবৃতিতে বুশ বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার জানতে পেরেছে যে, সম্প্রতি সাদ্দাম হোসেন আফ্রিকা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমান ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে। ’
এর কয়েক মাস আগেই উইলসন নাইজারে ভ্রমন করেছিলেন। সেসময় তিনি সিআইএর অনুরোধে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে সেখানে যান এবং অনুসন্ধানে তিনি জানতে পারেন যে অনুমানটি পুরোপুরি মিথ্যা। কিন্তু বুশ প্রশাসন যখন ওই ইস্যুতে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলো তখন অনেক বেশি আহত হন উইলসন। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই উইলসন জনসমক্ষে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের বিপরীতে ‘আফ্রিকাতে আমি যা খুঁজে পাইনি’ শিরোনামে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন লেখেন।
কিন্তু উইলসনের এই প্রতিবাদের ফলাফল হলো ভয়াবহ। শুধুমাত্র উইলসনের বিরুদ্ধেই নয়, সিআইএ থেকে তার স্ত্রী ভ্যালেরি প্লামের চাকরি চলে যায়। এর ফলে ভ্যালেরির জীবন যেমন এক প্রকার সঙ্কটের মধ্যে পরে তেমনি চাকরিকালীন সময়ে তিনি ইরাক এবং তার বাইরে যেসকল সোর্স তৈরি করেছিলেন তারাও সমান বিপদের মুখে পড়েন।
বর্তমানে ওই দুইজন, তাদের সন্তান এবং তাদের পোষা কালো ল্যাবরেডর কুকুর নিয়ে তারা দুরে কোথাও অবস্থান করছেন। যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রেও থাকেন তাহলেও তারা ওয়াশিংটন থেকে অনেকটা দুরে অবস্থান করছেন। ওই ঘটনার পরেও এখনও উইলসনের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি। এমনকি তাদের প্রতি যে হুমকি তা কি ভেতর থেকে না বাইরে থেকে তা স্পষ্ট নয়।
আমাদেরকে একটু বিস্তৃত করে দেখতে হবে, কেন বুশ প্রশাসন ইরাককেই লক্ষবস্তু বানালো। এবিষয়ে উইলসন প্রথমত উল্লেখ করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের বক্তব্যকে। সেই বক্তব্যে রোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানকে টার্গেট করে এখন আর লাভ নেই, টার্গেট করতে হবে বাগদাদকে। ’
স্মৃতি হাতরে উইলসন জানায়, ‘একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে বুশ এক বিবৃতিতে ‘তারা আমার বাবাকে হত্যা করতে চেয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ’
কিন্তু উইলসন বিশ্বাস করেন যে, ‘আমেরিকার নতুন শতাব্দী নামে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল তার ভেতরেই মূল কারণ নিহিত আছে। সেখানে বলা হয়, ‘নিউ-কনস’(নব্য রক্ষণশীলতাবাদী) নামের একটা গ্রুপ বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সামরিক আধিপত্য বিস্তারে কাজ করবে। অনেকটা রোমান শাসনের মতো। এটা পরিস্কার যে, ওইরকম এক বিশাল আধিপত্যবাদী-সাম্রাজ্যবাদী সাম্রাজ্য স্থাপন করতে হলে অনেক বড় কোনো ঘটনা ঘটতে হবে। যেমন হয়েছে পার্ল হারবার ও ৯/১১ এর বেলায়।
এরই সূত্র ধরে উইলসন যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে নিউ কনসরা ওই নীতি মেনে নেয়। একই সঙ্গে তারা এও বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পথ জেরুজালেমের ভেতর দিয়ে আসবে না। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আসবে বাগদাদের ভেতর দিয়ে। ’
৯/১১ বৈশ্বিক ইস্যু তৈরিতে একটা আজুহাত হিসেবে কাজ করেছে কিনা এমন এক প্রশ্নের উত্তরে উইলসন বলেন, ‘অজুহাত কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে তারা এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। ’
বুশ প্রশাসন যে এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে সেটা আরও একজনের মাধ্যমেও পরিস্কার হয়। তিনি হলেন জিউফ মিলার্ড। তার তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল গার্ড ইউনিট ৯/১১ সন্ধ্যার সময় বিধ্বস্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে নিযুক্ত হন। আবার তাকেই ইরাক যুদ্ধে ৪২তম আর্মার্ড ডিভিশনের সদস্য হিসেবে পাঠানো হয়েছিল এবং তিনি তাদের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গেও কাজ করতেন।
জিওফ তার সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার আলোচনার কথা স্পষ্ট মনে করে বলেন, ‘আমি আমাদের ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্তের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলতাম। তবে সবসময় নয়। তিনি আমার সঙ্গে কিভাবে ইরাকে আমরা আল কায়েদা সেটআপ করেছি সেবিষয়ে কথা বলতেন। যার কারণে আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবেই কাজ করতেন কারণ ইরাকে আল কায়েদা এবং লাদেনের আল কায়েদার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ’
‘একটা মিথ্যা কয়েক হাজার মার্কিন এবং ইরাকি মানুষের জীবন শেষ করে দিলো বলেও জানায় জিওফ মিলার্ড। ’ মিলার্ড নিজে এবং তার মতো অনেকেই ইরাক যুদ্ধ থেকে শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন এবং মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধের জন্য প্রশাসনের ওপর রাগান্বিত।
আর তাই প্রশ্নটা আবারও ওঠে, কেন প্রশাসন ৯/১১ এবং ইরাকের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে গেল?
জিওফ বলেন, ‘৯/১১ এর সঙ্গে ইরাকের যোগাযোগ আছে কারণ আপনি ৯/১১এর বিপক্ষে যেতে পারবেন না। আমরা কয়েক ঘণ্টার ভেতর দুই হাজার মানুষ হারিয়েছি। এটাই ওই যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট এবং অবিরত মিডিয়া কাভারেজ আমাদের আরও শক্ত করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটা মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষই ৯/১১ এর ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এটাই মূলত আসল কেন্দ্রবিন্দু। ’
যুদ্দাহত ওই সৈনিকের দৃষ্টিতে, একটা সাধারণ ঘটনার কারণে এতো মৃত্যু, এতো ধ্বংস এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এতো মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১