ঢাকা: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে সেই ভয়াবহ হামলার ঘটনার দায় সবচে বেশি বইতে হচ্ছে যে দেশটিকে, সেটি আফগানিস্তান। ওই ঘটনার এক দশক পেরিয়ে গেলো।
৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলায় ৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর দাম আফগানদের দিতে হয়েছে স্বাধীনতা হারিয়ে, হাজার হাজার জীবন দিয়ে। মৌলবাদী তালেবান সরকারের পতন ঘটেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজও কি তারা সেই অর্থে স্বাধীনতা পেয়েছে? যেখানে প্রায়ই বোমাবিস্ফোরণে মানুয়ের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। একটি পুতুল সরকার টিকে আছে কোনো রকম। যেখানে এখনও জীবন প্রায় মূল্যহীন!
সেপ্টেম্বর হামলার পর তালেবান সরকারের মিত্র আল কায়েদাকে শায়েস্তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে হামলা চালায় পশ্চিমারা। খুব কম সময়ের মধ্যেই অবশ্য পতন ঘটে তালেবান সরকারের।
মৌলবাদী, নিপীড়ক তালেবান সরকার পতনের এই খবর দিতে উল্লসিত গোলাম নবীর বাবা ছুটে যান পাকিস্তানের এক শরণার্থী শিবিরে যেখানে তার পরিবার থাকে। মুহূর্তের মধ্যে এই খুশির খবর ছড়িয়ে পড়ে শিবিরজুড়ে।
ওই সময় শিবিরের অসহায় মানুষ আশা করেছিল একটি পশ্চিমা পরাশক্তির সাহায্য-সমর্থনে খুব শিগগির তারা একটি শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল আফগানিস্তানে ফিরতে পারবে।
সেই দিনের পর আজ দশ বছর পেরিয়ে গেলো। বিশ্বের সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ একটি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র এক দশক পার করেছে। কিন্তু এখন পাকিস্তান শরণার্থী শিবিরের সেই মানুষের মধ্যে খুব মানুষই তাদের জন্মভূমির স্থিতিশীলতার ব্যাপারে আশাবাদী।
খাবারের দোকানের দিকে ছুটে চলা ২২ বছরের তরুণ গোলাম নবী বলেন, ‘আমি এখানেই বেড়ে উঠেছি, পাকিস্তানই আমার দেশ। বাবা আমাকে আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেছে। বসবাসের জন্য আমি কখনোই ওখানে যাচ্ছি না। আমি পাকিস্তানী জাতীয়তা পেতে চাই। এটাই আমার বাড়ি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আফগানিস্তানের ওপর আমেরিকা না অন্য কেউ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে সেটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। আমি এখনো চারদিকে তাকায় কেউ আমার দিকে বন্দুক তাক করে আছে কি না। ’
তবে পাকিস্তানে পরবাসী হয়ে থাকা এই লাখ লাখ আফগান দেশে ফিরলে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই খুশিই হতেন।
কিন্তু এই উদ্যোগের জন্য তার প্রশাসনকে আস্থা ভোটে টিকে যেতে হবে। এই মুহূর্তে তার সরকার নানা সমস্যায় ভুগছে।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহী তালেবান মহল থেকে কারজাই সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
অনিশ্চয়তার শুরু যখন থেকে
লাখ লাখ আফগানের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) আক্রমাণের পর পরই।
এখন পাকিস্তানে যারা শরণার্থী হয়েছে তাদের বেশিরভাগই এসেছে সোভিয়েত আক্রমণের সেই সময়।
রুশ-আফগান যুদ্ধে এইসব মানুষ জনমের মতো হারিয়েছেন তাদের জন্মভূমি। মুজাহিদিনরা রুশদের পরাজিত করার পর আফগান যোদ্ধাদের নেতারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে আফগানিস্তান মূলত খ-বিখ- হয়ে পড়ে। এ কারণে সেই অর্থে আর স্থিতিশীলতা ফিরেনি। আর অসহায় শরণার্থীদেরও আর মাতৃভূমিতে ফেরা হয়নি।
কিন্তু যেই পশ্চিম তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তালেবান হঠানোর জন্য আফগানিস্তান আক্রমণ করলো, এখন এসে তাদের ওপর ভরসা পায় না পরবাসী আফগানরা।
তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা দেশে ফিরতে চান কিন্তু মনের এক কোণে ফিরতে না পারার আশঙ্কায়ই বারবার উঁকি দেয়। নানা সমস্যা সত্ত্বেও অনেকেই পাকিস্তানকেই নিজের দেশ ভাবতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। যদিও পাকিস্তানি পরিচয়পত্র ছাড়া এই আফগানরা এখানে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না বা কোনো সম্পত্তি কেনা বা ইজারাও নিতে পারেন না।
জীবনের তাগিদে অনেকে ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্য করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের অত্যাচারে প্রায়ই নাজেহাল হন তারা। প্রভাবশালী ও মাস্তানরা অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে এই ক্ষুদ্র ব্যবাসীদের কাছ থেকে।
তবে এতোসব ঝক্কিঝামেলা ও সমস্যার মধ্যেও থেমে নেই আফগানদের চিরাচরিত জীবন। বয়স্ক লোকেরা মিলে এখানে গঠন করেছেন তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জিরগা’। উপজাতিরা গ্রাম্য সালিশীবোর্ডের মতো এই সংগঠনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিবাদ মেটায়।
তরুণদের অবসর সময় কাটানো ও বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ক্রিকেট খেলা।
এদিকে শরণার্থীদের এই বোঝা বেশিদিন রাখতে আপত্তি রয়েছে পাকিস্তানের। এমনিতেই দেশটি চরমপস্থাসহ নানামুখী সম্যায় জর্জড়িত। অবশ্য দুই বছর আগে আফগান শরণার্থীদের ২০১২ সাল পর্যন্ত থাকতে দিতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান সরকার।
শেরুল্লাহর মতো অনেক আফগান রয়েছে যারা সবসময় নিজেদের অরক্ষিত মনে করেন। তাদের ভয়, কখন পাকিস্তান সরকার তাদের চলে যেতে বলে। শেরুল্লাহর ৯টি সন্তান, এরা সবাই জন্ম নিয়েছে পাকিস্তানে।
পাকিস্তান শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আফগানদের মধ্যে নিবন্ধিত রয়েছে ১৭ লাখ মানুষ। কিন্তু আরও ৮ লাখ আফগান রয়েছে যাদের কোনো বৈধ কাগজ-পত্র নেই।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে পাকিস্তানে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আফগান। এই অতিরিক্ত শরণার্থী দেশটির অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১