বেপরোয়া থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে তার অভিংশসনও।
---
ন্যায়বিচারের অন্তরায় হিসেবে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছেন বিধায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসনে কংগ্রেসের প্রক্রিয়া শুরুর সময় এসে গেছে।
অভিশংসন-প্রতিকার আমাদের সাংবিধানিক পদ্ধতি সুরক্ষার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছিল। নির্বাহী-শাখার সেই কর্মকর্তাদের অপসারণের জন্য এই অভিশংসন প্রক্রিয়া চর্চা হয়ে থাকে, যে কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে করতে ‘সর্বোচ্চ অপরাধ ও অপকর্মের জন্য অভিযুক্ত’ হয়ে পড়েন। তখন সেই অপরাধ আর অপকর্মই তাদের ক্ষমতা অপব্যবহারস্থলে থাকার যৌক্তিকতা রাখে না।
আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট এর আগে ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে অভিশংসিত হননি। যদিও অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটনকে অভিশংসন করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের ভুরি ভুরি অভিযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কেউ জড়িয়েছিলেন নারী কেলেঙ্কারিতে, কেউ অব্যবস্থাপনায়। অভিশংসনের মুখে পড়তে যাওয়ার আগে পদত্যাগ করা রিচার্ড নিক্সনও নির্বাহী ক্ষমতার যাচ্ছে-তাই ব্যবহারের জন্য হোয়াইট হাউস ছাড়েননি, বরং বিরোধী শিবিরে আঁড়িপাতার কারণে (ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি) তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কিন্তু এখন এমন এক প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি হয়েছে এই জাতি, যার কর্মকাণ্ড আমাদের সরকার ব্যবস্থার জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার বহু কারণ আছে এবং তার বিরুদ্ধে অভিশংসন-প্রতিকার দাঁড় করানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার অনেক যৌক্তিকতা আছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত অধিদফতরের (এফবিআই) পরিচালক জেমস কোমিকে বরখাস্ত করার আগে থেকেই এই কারণ ও যৌক্তিকতা দৃশ্যমান ছিল। এখন বরং সেই যৌক্তিকতা পোক্ত হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের প্রচারণা শিবিরের যোগাযোগ থাকার বিষয়টির তদন্ত এফবিআই জোরদার করার কারণে এই বরখাস্তাদেশ দেওয়া হয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট জাতীয় টেলিভিশন ভাষণে যে ঔদ্ধত্য ভঙ্গিতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তা কেবল তাকে অভিশংসন করার বিবেচনাকে তাড়িত করার তাগিদ দিয়েছে।
এমনকি সবচেয়ে বড় যে আলোচনায় এখন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে গোপন যোগাযোগ সংক্রান্ত বিষয়াদি’ বাদ দিলেও ট্রাম্পকে অভিশংসন করার মতো গুরুতর অপরাধ শুরু থেকেই সংগঠিত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো পররাষ্ট্রনীতিকেন্দ্রিক ময়দানে ট্রাম্পের বারবার নির্লজ্জ বাধা হয়ে দাঁড়ানো, বিদেশি শক্তির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের স্বদেশের প্রতি অবিভাজিত অানুগত্য পথ হারাতে থাকলে যে নীতি দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়।
আর অপেক্ষা নয়। এসব বিষয়ে চলমান তদন্তগুলোর ফলাফলের জন্য আরও অপেক্ষা করার অর্থ হচ্ছে একজন স্বৈরাচারী নেতার খেয়ালখুশির কাছের জাতির ভাগ্য সঁপে দেওয়া।
এফবিআই পরিচালক কোমিকে আকস্মিক বরখাস্ত করে ট্রাম্প হয়তো ভেবেছেন সেসব তদন্তের গতিরোধ করবেন। কিন্তু তা থামানো যাবে না। উপরন্তু এই বরখাস্তাদেশ জাতীয় নিরাপত্তায় জড়িত একটি চলমান তদন্তে পরিষ্কার হস্তক্ষেপ বলেই প্রতীয়মান হয়েছে, যেটা নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার চেয়েও বেশি প্রকাশ্য ও স্পষ্ট মনে হচ্ছে সবার কাছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রশ্ন এবং ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের আশঙ্কাটি আমাদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পদ্ধতি ও সক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে ভাবুন, ট্রাম্প কিভাবে তার একক বরখাস্তাদেশের প্রেক্ষাপটে অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রড রোসেনস্টেইনকে হেনস্থা করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে গোপন যোগাযোগ তদন্তের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে সেশন্সের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও। আরও ভাবুন, কিভাবে ট্রাম্প তার ভাইস প্রেসিডেন্ট (মাইক পেন্স), তার বাসভবন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের নিজের নির্ভেজাল-নিগূঢ় মিথ্যাচারে ব্যবহার করছেন।
উদ্বেগের বিষয় হলো ট্রাম্প এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঔদ্ধত্য ভঙ্গিতে দাবি করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তার শিবিরের যোগাযোগের ইস্যু তদন্তের ব্যাপারে তিনি কোমির কাছ থেকে নিশ্চয়তা চেয়েছেন যে, তার ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে কিনা। তখন কোমির কাছে এফবিআই প্রধান পদে থাকার বিনিময়ে নিজের আনুগত্যও দাবি করেন ট্রাম্প। জবাবে কোমি ‘সততা’ রাখবেন বলে জানিয়েছিলেন ট্রাম্পকে। তারপর এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেছিলেন, এফবিআই আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে না। কিন্তু তদন্ত জোরদার হতে থাকায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে কোমিকে চাকরিচ্যুত করে ফেললেন।
এই প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে বলছেন, চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে আনুগত্য দাবি করা ভুল কিছু নয়! রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে খেয়ালখুশি মতো ব্যবহারের আর কতো বড় উদাহরণ হতে পারে!
ট্রাম্প যে আসলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে উঠছেন তা তার তৎপরতাই প্রতিষ্ঠিত করছে। নিক্সন ও ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পর ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্তরায়’ হয়ে ওঠার বিষয়টিই সামনে এসেছিল। কিন্তু কার্যত কেউই ট্রাম্পের মতো জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়ার মতো গুরুতর প্রশ্নে শূলে চড়েননি। ক্লিনটন জড়িয়েছিলেন নারী কেলেঙ্কারিতে, আর নিক্সন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দলীয় বা রাজনৈতিক ব্যবহারে (ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে)।
ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ঘটছে মিথ্যা বিবৃতি, কেন্দ্রীয় তদন্ত কর্মকর্তাদের তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো, এফবিআই বা সংসদীয় তদন্তে (কংগ্রেসশনাল) হস্তক্ষেপ করা, চলমান অপরাধমূলক তদন্তে এফবিআই’র দেয়াল ভেঙে দেওয়া, জনতার সামনে বারবার মুলো ঝোলানোর মতো কাজ। বিশেষত এফবিআই বা অন্যান্য তদন্ত সংস্থা বা অধিদফতরগুলোর কাজে তার সরাসরি বা ভার্চুয়ালি নাক গলানো প্রধান আলোচ্য হয়ে উঠছে।
এই সব বিবেচনায় নিয়ে এখন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্টের নিজের দলের পক্ষ থেকে তার অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য দরকার সাংবিধানিক নীতির প্রতি অবিচল অঙ্গীকার এবং অদম্য ইচ্ছেশক্তি। সেজন্য ব্যক্তিস্বার্থ ও দলানুগত্যকে বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোর্ধ্বে দেখতে হবে। কিন্তু সিনেটর ও রিপ্রেজেন্টেটিভসরা (কংগ্রেসের দুই কক্ষের সদস্য) যদি ২০১৮ সালের নভেম্বর (কংগ্রেস নির্বাচন) নিয়ে চিন্তায় বসে থাকেন (যে তাদের নিজেদের কী হবে) তবে সেটা হবে চরম লজ্জার।
এখন সাংবিধানিক নীতিমালার প্রতি অবিচল আনুগত্য হোক আর রাজনৈতিক অস্তিত্ব টেকানোর দায় হোক, সবার সামনে কেবল অভিশংসন ও ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়টিই ঘুরছে। আরও বড় বিষয় হলো এই বিষয়টিই এখন সবাই প্রধান বিবেচ্য হিসেবে নিয়েছে, যে কারণে অভিশংসন প্রক্রিয়ার যোগাড়-যন্ত্র পুনরায় চালু হচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আলোচনা শুরুর আগে তো এই বিষয়টিই সবার প্রধান আলোচ্য হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
এইচএ/