পাশের দেশগুলো থেকে, যারা কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, কাতারের নাগরিকদের দুই সপ্তাহের মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছে। অন্তত আটটি দেশ এরই মধ্যে কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
কাতারের বর্তমান বাসিন্দা সব মিলিয়ে ২৩ লাখ। যার সিংহভাগই প্রবাসি শ্রমজীবী মানুষ। বাংলাদেশেরও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে কাতারে। যদিও এরই মধ্যে সেদেশে বাংলাদেশের রাষ্টদূত ঘোষণা দিয়েছেন, কাতারে বাংলাদেশিদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। তবের ঘটনা প্রবাহ যখন দ্রুতই বদলাচ্ছে তখন চূড়ান্ত করে কিছু বলাও সম্ভব নয়।
কূটনীতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়া কাতারের জনগণ এরই মধ্যে ভাবনায় পড়ে গেছে কি ঘটতে যাচ্ছে দেশটির ভাগ্যে। বিশেষ করে স্রেফ আমদানি করা খাদ্যে যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের উদরপূর্তি হয়, সেখানে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়বে বৈকি!
যে কারণে কাতারের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা তার মূলেই রয়েছে- সন্ত্রাসবাদে অন্যতম অর্থযোগানদাতা বলে দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ। যার ফলে গোটা এলাকা এখন অস্থিতিশীল।
যদিও কাতার এই অভিযোগ বেশ জোরের সাথে অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, এ অভিযোগ অন্যয্য ও ভিত্তিহীন।
যে আটটি দেশ কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সেগুলো হচ্ছে- সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, বাহরাইন, ইয়েমেন, লিবিয়া, মরিসাস ও মালদ্বীপ। এদের মধ্যে সৌদি আরব, স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। আমিরাত কাতারের যে কোনও ফ্লাইট ও জাহাজের জন্য বিমানবন্দর ও নৌবন্দরগুলোয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যার ফলে ইতিহাদ, এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই ও গাল্ফ এয়ারের কোনও ফ্লাইট আর দোহা যাচ্ছে না। কাতার এয়ারওয়েজের কোনও ফ্লাইটও সৌদিআরব যাচ্ছে না। এসব দেশে কাতারের কূটনীতিকদের অনতিবিলম্বে এবং কাতারি নাগরিকদের ১৪ দিনের মধ্যে দেশে ফিরে যেতে বলেছে। এছাড়াও নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের ওপরও এলান জারি হয়েছে তারা কেউ যেনো কাতারে না যান।
এসবের পেছনে আসলে কি ঘটনা সেটি বড়ই জটিল। অনেকদিন ধরেই সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ উচ্চারিত হয়ে আসছে কাতারের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড নামের শতবর্ষের পুরোনো সংগঠনটির কথা বলা হচ্ছে। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত উভয় দেশই এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে জ্ঞান করে আসছে।
এছাড়া ২০১৫ সালে কাতার রাজ পরিবারের কয়েকজন সদস্য সহ মোট ২৬ জনকে আল কায়েদা অপহরণ করে নেওয়ার পর তাদের ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। ওই মুক্তিপনকে অাল-কায়েদাকে অর্থায়নের সামিল বলে ধরা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি কেবল এই একটি ক্ষেত্রে প্রোথিত নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন ইরানের সাথে কাতারের ঘনিষ্ঠতাও এই বর্তমান সঙ্কটের একটা অন্যতম কারণ। কাতারের আমির শেখ তামিম আল হামাদ আল থানির একটি মন্তব্যের জের ধরে দুই সপ্তাহ আগে আল-জাজিরাসহ কাতারের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশরে নিষিদ্ধ করা হয়। কূটনীতিক সঙ্কট শুরু হয় তখন থেকেই। ওই মন্তব্যে আল থানি ইরানকে ‘ইসলামিক শক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তেহরান নীতির সমালোচনা করেন।
বুধবার বিশ্বমিডিয়াগুলো বলছে ওটি ছিলো আসলে একটি ‘ইমপ্লান্টেড’ নিউজ। কাতার আগেই দাবি করেছে এটি আসলে একটি ভূয়া খবর (ফেক নিউজ) আর সিএনএন’র একটি এক্সক্লুসিভ খবরে বলা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই জানতে পেরেছে রাশিয়ার হ্যাকাররা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, তারাও মনে করেন প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এর মিত্র দেশগুলোর সম্পর্কে চির ধরাতে এটা রাশিয়ার কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
সেতো কর্মকর্তাদের কথা। কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন অন্য কথা। কাতার ক্রাইসিসে তিনি বেশ গদগদ। এরই মধ্যে তার সেরা অস্ত্র টুইটারে সে নিয়ে টুইট করেছেন ট্রাম্প। তাতে বলেছেন, সম্প্রতি তিনি যে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে গেছেন, তা ফল পেতে শুরু করেছে। তার প্রধানতম উদ্দেশ্য সন্ত্রাসবাদকে কব্জা করা। আর কাতারের ওপর আরব দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে তা কাঠামো পেতে শুরু করেছে।
পুরো বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে এমনটা আঁচ করে মুখ খুলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তিনি এরই মধ্যে একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তাতে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যুদ্ধ বেঁধে গেলে কেউ রেহাই পাবে না।
তবে সঙ্কটের মূলে ওই ভূয়া খবর কিংবা আল থানির একটি বিশেষ মন্তব্য যে নয়, তা বিশ্লেষক মাত্রই বুঝতে পারেন। তারা ইরান ইস্যুটাকেই এখানে বেশি গুরুত্ব দিতে চান। বেশ কিছু আঞ্চলিক বিষয়ে ইরানের সাথে সৌদিআরবের টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইরানের পরমানু শক্তি। এতদাঞ্চল মনে করে ওই শক্তিবলেই সিরিয়া, লেবানন ও প্রতিবেশি ইয়েমেনের ওপর সৌদির চেয়ে ইরানের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
সেখানেই শেষ নয়। আছে অর্থনীতি প্রসঙ্গও। কাতার ও ইরান সমুদ্রতলে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস ফিল্ডটির যৌথ মালিক। তবে সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে এই সম্পর্ক কিছুটা সামরিক খাতেও বিস্তৃতি পাচ্ছে। কাতারের কর্মকর্তারা ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পের সাথে যে বৈঠক করেছেন সে খবরও চাউড় হয়েছে।
সব মিলিয়ে নিষেধাজ্ঞা ও বিচ্ছিন্নতা যখন বাস্তবতা তখন তা কাতারকে ভোগাবেই। দেশটি গ্যাস সম্মৃদ্ধ হলেও নিজে উৎপাদন করেনা একটি শস্যকণাও। খাদ্য বলতে কাতারের যা কিছু তার সিংহভাগ বা প্রায় সবটাই যায় সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরবের সাথে সকল সীমান্ত পথ এখন বন্ধ। ফলে খাবারের দাম যে দেশটি আকাশ ছুঁবে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। খবর রয়েছে, খাদ্য সঙ্কটের কথা ভেবে এরই মধ্যে কাতারিরা মওজুদের জন্য ছুটতে শুরু করেছেন।
কাতার এয়ার বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান এয়ারলাইন্স। এরই মধ্যে সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আকাশসীমা এর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। মানেই হচ্ছে আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার পথে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট যেতে হলে দীর্ঘপথ ঘুরে যেতে হবে। এতে জ্বালানির দাম বাড়বে, ফ্লাইট সময় বাড়বে, আর ফলে বাড়বে টিকিটের দামও।
কাতারের নিজস্ব বর্ম অবশ্য আগে থেকে প্রস্তুত। এর রয়েছে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের নিজস্ব সম্পদ তহবিল। যা গঠন করা হয়েছে ২০০৫ সালে। দেশটির নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েই এই বিশাল অর্থভাণ্ডার প্রস্তুত রাখা হয়েছে যে কোনও অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবেলার জন্য। আরেকটি বড় কথা কাতরিরা কিন্তু নিজ দেশে নিজেরাই সংখ্যালঘু। এর ২৩ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ২০ লাখই হচ্ছে বিদেশি শ্রমিক। প্রধানত ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ফিলিপাইনের নাগরিকরাই দেশটিতে গিয়ে কাজ করছে। এই সঙ্কটের প্রভাব এসব দেশের ওপর পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ বলেছে সঙ্কট হবে না, তবে ফিলিপাইন ঘোষণা দিয়েছে তারা কাতারে এখনই আর কোনও ফিলিপিনোকে পাঠাচ্ছে না। ভারত তাদের অভিবাসীদের ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কাতার ক্রাইসিস শুধু কাতারের জন্যই সঙ্কট হয়ে থাকবে না। গোটা বিশ্বেই এর কিছু না কিছু প্রভাব পড়বে। বলাই হয়, মধ্যপ্রাচ্যের কোনও একটি দেশে সঙ্কট দেখা দিলে দ্রুতই বেড়ে যায় তেল ও গ্যাসের দাম। যার প্রভাব গিয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এরই মধ্যে তার লক্ষণ প্রকাশ পেতেও শুরু করেছে। কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি রপ্তানিকারক। গোটা উপসাগরীয় অঞ্চলে এর পাইপলাইন বিস্তৃত। এখন কাতার নিজেই যদি প্রতিবেশিদের জন্য সরবরাহ চ্যানেল বন্ধ করে দেয় তখন কি ঘটবে তা বুঝতে হলে অপেক্ষাই করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কাতার হতে যাচ্ছে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের হোস্ট। যার প্রস্তুতি চলছিলো। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা ওই আয়োজনকেই এক নতুন জটিলতায় ফেলে দেবে। যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা দীর্ঘায়িত হলে বিপদ বাড়বে। গোটা প্রস্তুতি হযে পড়বে অনেকাংশেই অসম্ভব।
পুরো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশ নিয়ে আরো কিছু তথ্য জানা থাকা প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট আর তার বিপরীতে পেন্টাপনের দ্রুত ভিন্নমত দেওয়ার প্রসঙ্গটিতে রয়েছেই। ট্রাম্পের টুইটের পরপরই পেন্টাগনের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন জেফ ডেভিসতো দ্রতই সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, তারা বরং কাতারের প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিটি কাতারেই অবস্থিত যাতে দেশটির ১১ হাজার সেনা রয়েছে।
এছাড়াও কাতারের অর্থায়নে আল উদিদ বিমান ঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আইসিস বিরোধী জোট হামলা চালিয়ে আসছে।
তবে মে’র তৃতীয় সপ্তাহে ট্রাম্পের সৌদিসফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও রয়েছে। ওই সময় সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্র যে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি করে সেটি আজ বড় ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। ওই চুক্তির মধ্য দিয়েই প্রতিবেশি দেশগুলোর প্রতি সৌদি বাদশাহর চোখ রাঙানি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এখন যদি কাতারের সাথে যুদ্ধ বেঁধেই যায় ওই অস্ত্রের ব্যবহার দেখলে বিষ্মিত হওয়া কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশ সময় ১২১৮ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৭
এমএমকে