ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

‘আমরা ক্ষমতা ছাড়তে রাজি’

কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১
‘আমরা ক্ষমতা ছাড়তে রাজি’

[ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। গত জুন মাসে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হামলায়  মারাত্মক আহত হয়েছিলেন।

দীর্ঘ তিন মাস সৌদি আরবে চিকিৎসা নিয়ে মাত্র দিনকয় আগে ইয়েমেনে ফিরেছেন। এতকিছুর পরও তিনি রাজি হয়েছেন প্রভাবশালী দুই পশ্চিমা গণমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন এবং ওয়াশিংটন পোস্টকে  সাক্ষাৎকার দিতে। ২৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার তিনি টাইমের অ্যারিয়ান বাকের এবং ওয়াশিংটন পোস্টের সুদর্শন রাঘবনকে সাক্ষাৎকার দেন]

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: আমরা আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। জুন মাসের ২ তারিখ কারা কারা অথবা কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠি আপনাকে হত্যা করতে হামলা চালিয়েছিল-- এব্যাপারে আপনার কি কোনো ধারণা আছে?

সালেহ: আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় আপনাদের ধন্যবাদ। ওই হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান হয়েছে। তখন তারা কথা দিয়েছিলো, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ঘটনা পর্যালোচনা করে তারা আমাদের জানাবে। সুতরাং ওয়াশিংটনের বিশ্লেষণ জানার জন্য এখনও আমরা অপেক্ষা করে আছি।

টাইম/ওয়াশিংটন: আপনি জিসিসি’তে (ইয়েমেনের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরের লিখিত প্রক্রিয়া) স্বাক্ষরের জন্য আপনার সহকারী আবদু রাব্বু মানসুর আল-হাদিকে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু আপনি যখন নিজেই এখন এখানে তাহলে সেটা কেন নিজে করছেন না? আপনি কি আমাদের ব্যাখ্যা করবেন ওই চুক্তিতে আসলে কী আছে এবং সরকার ওই চুক্তি সম্পর্কে কতটা সচেতন?

সালেহ: প্রথমত, প্রেসিডেন্টের এক ঘোষণাবলে ভাইস প্রেসিডেন্ট এই কাজ করতে পারে। আমি দেশের ভেতরে থাকি বা বাইরে থাকি তাতে কিছু আসে যায় না। আর এই ঘোষণাকে কেউ থামাতে পারবে না।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: চুক্তি স্বাক্ষরে ভাইস প্রেসিডেন্ট কতটা এগিয়েছেন?

সালেহ: ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতিপক্ষের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা জিসিসি’তে স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তুত। যদিও জেএমপি (বিরোধী জোট) একটা পয়েন্টেই কথা বলছে যে, প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন এবং ৩০ দিনের ভেতর ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে। জিসিসি’তে স্বাক্ষর -পরবর্তী ৬০ দিনে নির্বাচনের কথা আছে। কিন্তু নির্বাচন করার মতো প্রস্তুতি তাদের নেই। দেশ যখন একটা অস্থিতিশীল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তখন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার কি প্রয়োজন।

যেকোনো মুহুর্তে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য আমরা প্রস্তুত। কিন্তু  জিসিসি’র সবগুলো প্রস্তাব বাস্তবায়নে এবং তা কার্যকর করার জন্য একটা সময়সীমা দরকার আমাদের। আমরা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চাই না। চুক্তি অনুযায়ী আমরা ক্ষমতা ছেড়ে দিতেই আগ্রহী। এখন সেটা কয় দিনে এবং ঘণ্টায় তা আলোচনার বিষয়।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: তবু অনেকে বলছে আপনি ক্ষমতা ছাড়তে চাচ্ছেন না। তিনবার আপনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা বলেছেন এবং শেষ মুহুর্তে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করছেন, আপনি ক্ষমতা একত্রীকরণ করার জন্য সময় নিচ্ছেন। এই কালক্ষেপণ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

সালেহ: এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি। আমরা পরবর্তী ঘণ্টা এবং পরবর্তী দিনেই স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত যদি জেএমপি প্রস্তাবের কাছাকাছি আসে। আমরা এটাকে আর বাড়াতে চাই না। একই সঙ্গে এই সমস্যা আর বাড়–ক তা-ও আমরা চাই না। এই সমস্যা থেকে দেশ বের হয়ে আসুক সেটাই আমরা চাই। গণমাধ্যমগুলোতে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের ওই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আজ হোক, কাল হোক ক্ষমতার হস্তান্তর হবেই।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: আপনি এখনও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না?

সালেহ: (হাসি দিয়ে) আমি তো পদত্যাগ করবোই। সন্ত্রাসীরা প্রেসিডেন্সিয়াল মসজিদে আমার ওপর হামলা চালিয়ে সেই পদত্যাগে যাওয়া আরও ত্বরান্বিত করেছে।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: সম্প্রতি জেনারেল আলী মহসীন এবং আহমার গোষ্ঠির মাধ্যমে জনমনে আপনাকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। জনগণের এই সমালোচনার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি? সবার মাঝে যে সহিংসতা এবং অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে তাতে করে কি ইয়েমেনে সবাই আবার একত্রিত হতে পারবে?

সালেহ: কি ধরনের সমালোচনা?

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: জেনারেল আলী এক বিবৃতিতে বলেছেন, আপনি দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

সালেহ: তারা এই ধরণের বিবৃতি প্রতিদিনই দেয়। যারা সেনাবাহিনীর ঘাটিতে, বেসামরিক মানুষদের ওপর এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে তারা তাদেরই একজন। প্রতিবাদকারীরা সারা শহরে আলী মহসীন এবং আহমার গোষ্ঠির ছত্রছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সশস্ত্র অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা প্রতিবাদকারীদের পেছন দিয়ে অস্ত্র দিচ্ছে যাতে তারা এই রাষ্ট্রকে দোষারোপ করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সবকিছুই দেখছে এবং চোখ বন্ধ করে আছে। তারা ঠিকই জানে আসলে কি ঘটছে।  

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: তাহলে আপনি কি ভবিষ্যতে মহসীন এবং আহমারের সঙ্গে থাকবেন?

সালেহ: অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে হলে বলবো ‘হ্যা’, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যারা প্রেসিডেন্সিয়াল মসজিদে হামলা এবং দুই সপ্তাহ আগে জুবেইরি সড়কে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটিয়েছে তারা যে পক্ষেই থাকুক, তাদের আগে বিচারের কাঠগড়ায় আনা হবে।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: প্রতিবাদকারীদের ওপর আপনার দমনমূলক আচরণ সহিংসতার পর্যায়ে পৌছেছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ওপর বন্দুক এবং ভারি অস্ত্রের ব্যবহারের কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্ব আপনার প্রতি নিন্দা জানিয়েছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে আপনি কেন এ ধরনের সহিংস ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন?

সালেহ: এ ধরণের আক্রমন ইয়েমেনে সম্ভব নয়। ইয়েমেনের জনগণকে তাদের নিজস্ব মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার দিয়েছে ইয়েমেনের সংবিধান। কিন্তু এই আক্রমণগুলো কোনো একটা গেষ্ঠি করছে। যারা রাষ্ট্রের ঘাড়ে সকল দোষ দিতে চায়। তারা দাবি করছে, তারা প্রতিবাদ করছে। এটা একপ্রকার গণমাধ্যমমুখি প্রবণতা। কিছু গণমাধ্যম আছে যারা এই সরকারের পতন চায় এবং জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রীদের দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়।

এখন তারা ইসলামপন্থীদের দিকে যাচ্ছে। এর বড় প্রমাণ, তারা রাজধানী সানাবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে। সরকার প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বলে তারা প্রচার করছে।

 কিন্তু অন্যদিকে তারাই আবার প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আবিয়ানে আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের সহায়তায় আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা জানলো যে, আল কয়েদা মুসলিম ব্রাদার হুড(বিরোধী ইসলাহ পার্টি। এটি জেএমপি জোট অন্তর্ভূক্ত) এবং বিরোধী সেনাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মুসলিম ব্রাদার হুড ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলেছে, ‘আমাদের আবিয়ান দিয়ে দাও, আমরা যুদ্ধ থামিয়ে দেবো। সেখানটায় আল কায়েদার নেটওয়ার্ক এখানে আছে। ’

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: আপনি কি মনে করেন আলী মহসীন এবং আহমার গোষ্ঠিকে বিচারের আওতায় আনা উচিত? তারা তাদের এই প্রভাবশালী অবস্থানে থাকার পরেও কি আপনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন?

সালেহ: এটা নির্ভর করে ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর।
 
টাইম/ওয়াশিংটন: তারা যদি প্রভাবশালী অবস্থানে থাকে তাহলেও কি আপনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন?

সালেহ: না। জিসিসি’র বক্তব্য পরিষ্কার। এতে বলা আছে, যেসকল উপাদান উত্তেজনা সৃষ্টি করে সেগুলোকে দুর করতে হবে। কারণ আমরা যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করি এবং তারা সেখানেই থাকে, এর মানে এই দাঁড়ায় যে, আমার একটা অভ্যুত্থানের মধ্যে পড়লাম। আমরা যদি ক্ষমতা ছাড়ি এবং তারা যদি তাদের অবস্থানে থাকে, তাহলে তারাই এখনও নীতিনির্ধারকই থাকলো। এটা খুবই ভয়ংকর হবে। আর এটা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।

টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: আমি আপনাকে ইয়েমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। আপনি ইয়েমেনে ফেরার পর এই বিষয়টি এখন বেশ গুরুত্ব বহন করছে।

সালেহ: এটাই আপনার শেষ প্রশ্ন। ইয়েমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো। বিগত ৩৩ বছর ধরে এই সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরেনি। ওয়াশিংটনের অনেক রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। সেটা তারা ডেমোক্র্যাটিক অথবা রিপাবলিকান পার্টিই হোক না কেন। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইয়েমেনের ভূমিকার জন্য সম্পর্কে কিছুটা অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমেরিকানরা বুঝতে পেরেছিল, আমরা সঠিক ছিলাম এবং ইরাকের সিংহাসন রক্ষা করাই শুধু আমাদের লক্ষ্য ছিল না। অন্য উদ্দেশ্যও ছিল।
 
টাইম/ওয়াশিংটন পোস্ট: কিন্তু আমেরিকানরা ...

সালেহ: আমি আমেরিকান জনগণদের বলছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই: আপনারা কি এখনও তালেবান এবং আল কায়েদার ওপর অব্যাহত অভিযান চালানোর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন? যদি ওয়াশিংটন আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নিয়ে তালেবান এবং আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায় তাহলে কারা বিশ্বশান্তি বিনষ্ট করছে? যদি হ্যাঁ হয় তাহলে ভালো। কিন্তু আমরা কি দেখতে পাই, যখন আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলে। আমরা জানি কোথায় ক্ষমতা যাবে। ক্ষমতা যাবে আল কায়েদার হাতে। আর আল কায়েদা মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশ সশয়: ১৯০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।