সোমবার (১৬ অক্টোবর) ২৮ দেশের জোট ইইউ’র পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক পরিষদের (সিইইউএফএ) এক বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি শেষে এক বিবৃতিতে বিষয়টি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে ব্যবহার হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিতে নিষেধাজ্ঞাসহ মিয়ানমারের ওপর বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে কড়াকড়ি আছে তার যৌক্তিতা জোটের সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংকটের ইতিবাচক অগ্রগতি না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার বিবেচনা করতে পারে জানিয়ে বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, ইতিবাচক অগ্রগতি হলে সেভাবেই আচরণ করবে ইইউ।
গত ২৪ আগস্ট সরকারি স্থাপনায় বিচ্ছিন্ন হামলার অজুহাতে ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে সর্বাত্মক অভিযানে নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের তথ্যমতে, এই অভিযানে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাঁচতে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘই। অভিযান শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া সমালোচনা ও নিন্দা শুনতে হচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে।
এই ইস্যুতে সিইইউএফএ’র বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে নিম্নোক্ত ৮টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
১. রাখাইনে মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘খুবই গুরুতর’। অব্যাহত অগ্নিসংযোগ, সহিংসতা, ল্যান্ড মাইন পুঁতে রাখা ও যৌন নির্যাতনের অনেক গভীর উদ্বেগজনক খবর আসছে, যার জেরে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এতো দ্রুত বিপুলসংখ্যক মানুষের গৃহহারা হওয়া সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উচ্ছেদ করারই ইঙ্গিত বহন করে। এখন সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো— এই শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে ব্যবস্থা করতে হবে। রাখাইনে মানবিক সহায়তা ও সংবাদকর্মীদের প্রবেশেও কড়াকড়ি রয়েছে, এই অবস্থারও নিরসন করতে হবে।
২. ইইউ রাখাইনে সব পক্ষকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। একইসঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে অভিযান বন্ধ করে কোনো বৈষম্য ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মাথায় রেখে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানাচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমন ও সংকট নিরসনে মিয়ানমার সরকারকে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানেরও পুনরাবৃত্তি করছে জোট। ইইউ’র পক্ষ থেকে বলা হয়, গৃহহারা রোহিঙ্গাদের বাপ-দাদার ভিটে-মাটিতে নিরাপদে, স্বেচ্ছায়, সসম্মানে ও স্থায়ীভাবে ফেরাতে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে।
৩. রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসহ রাখাইন প্রশ্নে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত ইইউ। সুপারিশমালা বাস্তবায়নে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনকেও স্বাগত জানাচ্ছে প্রভাবশালী এ জোট।
৪. মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ও অন্যান্য অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সম্প্রতি যে অঙ্গীকার করেছেন, সেটাকে স্বাগত জানাচ্ছে ইইউ। তবে, বিশ্বাসযোগ্য সব অভিযোগের পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্ত করতে হবে। মানবাধিকার পরিষদের স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের তদন্তে সর্বাত্মক সহযোগিতারও আহ্বান জানাচ্ছে জোট।
৫. সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের সমাধানে, বিশেষত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানাচ্ছে ইইউ। কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে সেটাকেও সাধুবাদ জানাচ্ছে ২৮ উন্নত দেশের এ জোট।
৬. মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে বলপ্রয়োগ করায় তাদের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জানানো সব আমন্ত্রণ স্থগিত করবে ইইউ ও তার সদস্য দেশগুলো। দেশটির সঙ্গে সব রকমের ব্যবহারিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও পর্যালোচনা করা হবে।
৭. রাখাইনের পাশাপাশি কাচিন ও শান রাজ্যেও লাখোধিক মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের কারণে গৃহহারা অবস্থায় রয়েছে। সেখানেও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগের পাশাপাশি শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. ইইউ আগামী নভেম্বরে নাইপিদোতে অনুষ্ঠেয় আসেম জোটের (এশিয়া-ইউরোপের ৫১ দেশ ও ২ সংস্থা) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সভায় এই ইস্যুতে গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ নিতে চায়। ইইউ আশা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আসেমের বৈঠকে গুরুত্বসহ আলোচনা করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
এইচএ/