যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টার ইমোরি ইউনিভার্সিটির রোজ লাইব্রেরির সংরক্ষণে ছিল এসব চিঠি। সেখানকার আর্কাইভে সংরক্ষিত এ ধরনের নয়টি চিঠি সম্প্রতি গবেষকদের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।
লাইব্রেরির পরিচালক রোজমেরি ম্যাগি বলেন, ‘চিঠিগুলো একজন তরুণ ছাত্রের অভিযাত্রার গল্প বলছে, যে খুঁজে বেড়াচ্ছে বেঁচে থাকার অর্থ ও জীবনের মানে। আছে আগামী দিনের দিক-নির্দেশনা নিয়ে বিভ্রান্তি। যে বুঝতে চাইছে সময়ের বুকে কোথায় হবে তার স্বতন্ত্র অবস্থান। ’
চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল
আশির দশকে অর্থাৎ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে প্রেয়সী অ্যালেক্সান্দ্রাকে চিঠিগুলো লিখেন ওবামা। ক্যালিফোর্নিয়ায় একই কলেজে পড়ার সময় ওবামা-ম্যাকনিয়রের মধ্যে পরিচয় হয়।
প্রেম হওয়ার পর অ্যালেক্সান্দ্রা ম্যাকনিয়রকে ‘অ্যালেক্স’ বলেই ডাকতেন তরুণ প্রেমিক ওবামা।
প্রেমে পড়ার প্রথমদিককার অ্যালেক্সকে নিয়ে ভাবনার কথা বলে চিঠিতে ওবামা লিখেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তুমিও জানো যে আমি তোমায় ভালোবাসি। আর সেটা বাতাসের মতো বিস্তৃত। তোমার প্রতি আমার আস্থাও সাগরের মতোই বিশাল। আমার ভালোবাসার দাম খুব বেশি, বড় বেশি বেদনাময়।
সাবলীল ভাষায় হাতে লেখা চিঠিগুলোতে প্রেমিকাকে প্রেমিক ওবামার সম্বোধন করেছেন ‘প্রিয় অ্যালেক্স’ বলে। আর চিঠির শেষ হয়েছে ‘ভালোবাসা, বারাক’ শব্দ দু’টো দিয়ে।
চিঠি লেখার ওই সময়গুলোতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান ওবামা। আর এর পাঁচ বছর পরই মিশেলের সঙ্গে তার দেখা হয়; যাকে পরবর্তীতে বিয়ে করেছেন তিনি।
‘চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল’ একথাও যেনো সত্যি হলো ওবামা-অ্যালেক্সের মধ্যে। দূরে চলে যাওয়ার তাদের সেই সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি।
১৯৮৩ সালে ওবামা অ্যালেক্সকে লেখা আরেকটি চিঠিতে বলেন, ‘তোমার কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, যদিও নিজের অনুভূতি নিয়ে আমি বিভ্রান্তিতে থাকি। ’
‘মনে হয়, যা পাওয়ার নয় তাই আমরা চাই। সেই চাওয়াই আমাদের মিলিয়ে দেয়, সেটাই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটায়। ’
নিজের পথের খোঁজে…
অপর এক চিঠিতে তরুণ ওবামা লিখেন, পড়াশোনা শেষ করে তার বন্ধুরা পারিবারিক ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে স্থায়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু হাওয়াইয়ে জন্ম নেওয়া কেনিয়ার নাগরিক বাবার ছেলে ওবামার জন্য এ ছিল এক ভিন্ন পরিবেশ। যার শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইন্দোনেশিয়ায়।
ওই সময় বন্ধুদের থিতু হওয়া দেখে যে ঈর্ষা হয়েছিল, সে কথাও অকপটে চিঠিতে স্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুইবারের প্রেসিডেন্ট। তিনি লেখেন, ‘এ নিয়ে আমার ঈর্ষাকাতরতার কথা স্বীকার করতেই হবে। ’
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সমাজের কোনো শ্রেণী, কাঠামো বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছিলেন না আফ্রো-আমেরিকান বারাক ওবামা।
প্রেমিকার চিঠিতে তিনি বলেন, কোনো শ্রেণী, জাত-গোত্র অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য নেই যা আমাকে কিছু করতে সাহায্য করতে পারে। তাই এই শ্রেণী-জাত-গোত্রকে নিজের মতো করে সব কিছু গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু এটা করা ওবামার জন্যে অতো সহজ ছিলো না। ১৯৮৩ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর শৈশবের ইন্দোনেশিয়া ফিরে যান ওবামা। কিন্তু সেখানে তিনি আবিষ্কার করলেন, কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই।
প্রেমিকাকে লেখা চিঠিতে লিখেছেন, ‘দেখি ইন্দোনেশিয়ার ভাষাও আর ভালোভাবে বলতে পারছি না। ’
‘সবাই আমাকে অন্য চোখে দেখছে, কারণ আমি তখন আমেরিকান। আমার টাকা, আমার আমেরিকা থেকে আসার প্লেন টিকিট যেন আমার গায়ের কালো রঙকে ঢেকে দিচ্ছে। ’
তিনি লিখেন, ‘শৈশবের রাস্তাঘাট আগেরই মতো আছে, মাঠের পাশে ঘরবাড়িগুলোও তেমনি ভাঙাচোড়া, আমার চেনা পথগুলো। কেবল সেখানে আমার প্রবেশাধিকার নেই। ’
রোড টু হোয়াইট হাউজ
তরুণ গ্র্যাজুয়েট ওবামা চাইতেন বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে। এ জন্য অনেক তরুণের মতো তাকেও বাস্তবিক ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হয়।
১৯৮৩ সালে লেখা আরেক চিঠিতে ওবামা লিখেছেন, ‘এক সপ্তাহে আমি একটি বায়োডাটা ও নমুনা লেখা ডাকে পাঠাতে পারিনি। পরবর্তীতে টাইপরাইটারকে ভাড়া দিতে একটি চেক বাউন্স করতে হয়। ’
কাঙ্ক্ষিত চাকরি ও অবস্থানে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট অর্থ কষ্টের কথাও উঠে আসে ওবামার সেসব চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, ‘কমিউনিটি অর্গানাইজেশনে কাজ করতে গেলে যা বেতন পাবো, তা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। আশা করছি এ বছরটা এ চাকরি চালিয়ে যেতে পারলে ভবিষ্যতে নিজের পছন্দের কাজে মন দেওয়ার জন্য কিছু জমাতে পারবো। ’
এরই মধ্যে প্রকাশনা সংস্থা বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে চাকরি নেন তিনি।
ওবামার চিঠিগুলো বেশিরভাগই লেখা হয়েছে কলেজ নোটবুকের রুলটানা সাদা ও হলুদ পৃষ্ঠায়। অ্যালেক্সকে পাঠানো একটি চিঠিতে ‘বারাক ওবামা’ নামঙ্কিত রয়েছে, যেটি পাঠানো হয় বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের খামে।
ওই চিঠিতে ওবামা লিখেছেন, বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে চাকরি হওয়ার পর সবাই প্রশংসা করেছিল। সেখানে নিউজলেটার লিখতে হতো। কিন্তু সে কাজে মোটেও আগ্রহ পাচ্ছি না।
১৯৮৪ সালে ওবামা অ্যালেক্সকে লেখেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় আমার ধারণাগুলো যতোটা জমাট বাধা ছিল, এখন আর তেমনটা নেই। এখনকার ভাবনাগুলোর যে তাৎক্ষণিকতা আর ভার নিয়ে আসছে, তা হয়তো আরও বেশি কার্যকর হবে, যদি আমি শুধু দর্শকের ভূমিকায় না থেকে আরও একটু সক্রিয় হই। ’
সত্যিই বটে, বারাক ওবামার সেই সক্রিয়তাই শেষ পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অধিকর্তা পদে। টানা দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
এমএ/