রামজি বারুদ: প্যালেস্টাইন ক্রনিকল-এর সম্পাদক, দ্য সেকেন্ড প্যালেস্টিনিয়ান ইন্তিফাদা গ্রন্থের রচয়িতা। আন্তর্জাতিক কলাম লেখক ও গ্রন্থকার।
ঢাকা: সিরিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বেশ স্বতঃফুর্ত একজন কূটনীতিক। সিরিয়ার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থানে ঘোষণা এবং আমন্ত্রণ ছাড়াই তার মুখ দেখা গেছে অনেকবার। কোথাও তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে সিরিযার কিছু মানুষ আবার কোথাও প্রবল জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।
গত জুলাই মাসে তিনি যখন সিরিয়ার শহর হামা সফর করেন তখন হামার জনগণ তাকে বেশ সাদরেই গ্রহণ করেছিল। ফুল দিয়ে বরণ করে নিতেও দেখা যায় তাকে। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর তিনিই যখন ফের দেশটির রাজধানী দামেস্কে যান তখন দামেস্কের ক্ষুব্ধ জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে পচা ডিম, টমেটো আর পাথর ছুড়ে।
উইকিলিকসের ফাঁস করে দেওয়া বিভিন্ন তারবার্তায় দেখা যায়, আমেরিকার কূটনীতিকরা ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতির বাইরে কিছুই স্বাধীনভাবে করতে পারেন না বা করেন না।
ফোর্ডের সিরিয়া সফর শুধু সে দেশের সাধারণ জনগণের জন্যই, এটা ভাবা একেবারেই ভুল হবে। আমরা সবাই জানি এই অঞ্চলের মানুষ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করেন।
২০০৯ সালের ২৫ জুন এক ওয়েবসাইটে স্টিভ ক্র্যাবট্রি মার্কিন প্রশাসনের একটি বার্তা প্রকাশ করে। ওবামা প্রশাসন বার্তাটি সিরিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে পাঠায়।
ওই বার্তায় লেখা ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়ার মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সিরিয়ার জনগণের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব থাকলেও বৃহৎ স্বার্থের জন্য সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। ’
২০০৯ সালের মার্চে করা এক জরিপে দেখা যায়, সিরিয়ার ৬৪ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করে এবং ৭১ শতাংশেরও বেশি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মানতে নারাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়াবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির দিকে তাকালেই যে কেউ একমত হবেন, এ দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই যুক্তিযুক্ত।
এ অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে তাদের পাশ্বর্বর্তী দু’টি দেশ ইরাক এবং লেবানননকে ধ্বংস করে দিয়েছে, গত দশকেই তা প্রত্যক্ষ করেছে সিরিয়ার জনগণ। একই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নিপীড়নকারী দেশ ইসরায়েলকে যে সমর্থন দিয়ে আসছে সেটাও প্রত্যক্ষ করছে সিরিয়াবাসী।
দামেস্কেও একই ঘটনা ঘটিয়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পথ পরিষ্কার করতে চায় মার্কিন কংগ্রেস। তবে কিছু সিরীয় বিশ্বাস করে, বিক্ষোভকারীরা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেই পুষ্ট করছে।
এদিকে, ইরাক যুদ্ধে ওয়াশিংটনের জয়ের পর শাসন পদ্ধতি পরিবর্তনের ধাক্কা ইতোমধ্যে সামলে উঠতে পেরেছে সিরিয়া। আর এ ধাক্কা সামলাতে গিয়ে দু’টি শর্ত আরোপ হয়ে যায় সিরিয়ার ওপর।
এর একটি ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন করা যা সিরিয়া সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডা। অপরটি তথাকথিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীর ভূমিকা পালন করা।
ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের বন্ধুরা, বুদ্ধিজীবীমহল ও মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং সিরিয়ার প্রশ্নে হতাশ। কারণ তারা মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সিরিয়াকে একটা ডামাডোলের ভেতর ফেলে দিচ্ছে। আর তাই গতানুগতিকভাবে এর বিরোধিতা করছেন নব্যরক্ষণশীল রিচার্ড পার্ল, ডগলাস ফেইচ, ডেভিড ওয়ার্মসার এবং অন্যরা।
নব্যরক্ষণশীলরা সিরিয়ার ক্ষেত্রে ‘বশে রাখা নীতি’র চেয়েও বেশি কৌশল খাটাতে চাওয়ার কারণে বাস্তবতা আর আগের মতো নেই।
‘বশে রাখা নীতি’র মতো অজনপ্রিয় কৌশলের পরেও ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়া সীমান্তে শান্তি (আসলে সিরিয়ার নিজেরই দখল হয়ে যাওয়া গোলান মালভূমি) বজায় রাখার পাশাপাশি আরব বিদ্রোহের নেতৃত্বে চলে আসে সিরিয়া।
গত মার্চে সিরিয়ার জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমে পড়ে। আর এ সময় সরকার পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন অভিযান চালাতে শুরু করে শাসকগোষ্ঠী। বিশ্ববাসী দেখলো, গুলি আর গোলার আঘাতে কীভাবে সিরিয়ার জনগণ মৃত্যুমুখে নিপতিত হচ্ছে। কিন্তু এ মৃত্যুগর্ভেই জন্ম নেয় আরেক রাজনীতি। সিরিয়ার কিছু নাগরিক আবেগপ্রবণ হয়ে জনগণের পক্ষে যৌক্তিক দাবি নিয়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। অন্যরাও যে অসংগঠিত তা নয়। তারাও তাদের দাবিতে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। কিন্তু তা ততোটা যৌক্তিকতা পায়নি।
আগেই প্রকাশিত এক কূটনৈতিক তারবার্তা মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের গোপনে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। এছাড়াও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন সংক্রান্ত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। যাতে বিরোধীরা তাদের বক্তব্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। ’ এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয় ওই তারবার্তাটি।
আর এ তারবার্তাটি প্রকাশ করে গোপন তথ্য ফাঁসের ওস্তাদ উইকিলিকস।
তারবার্তায় দেখানো হয় কীভাবে বুশ প্রশাসেনর আর্থিক সহায়তা এবং এখনও ওবামা প্রশাসনের সহায়তা অব্যাহত রয়েছে সিরিয়ায়।
ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, ‘২০০৫ সালে বুশ প্রশাসনের সঙ্গে দামেস্কের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সরকারবিরোধীদের অর্থ সহায়তা দিতে শুরু করে। ’
যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও একই রকম অসফল পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করেছে বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে। ইরাকে সরকারবিরোধীদের সহায়তা করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা।
ধারণা করা হচ্ছে, একই পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। আর এখানেও চরম ব্যর্থতার দিকে যাবে মার্কিন এ পররাষ্ট্রনীতি।
তবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়াকে চাপে ফেলতেও পিছপা হচ্ছে না। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দামেস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে।
যদিও সিরিয়ার রাস্তায় ইতোমধ্যেই অবরোধ চলছে। কিন্তু এ অবরোধের ফলে অভিজাত শ্রেণীর তেমন একটা কিছু না হলেও সীমাহীন কষ্টে আছে সাধারণ জনগণ। সিরিয়ায় এখন খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী এবং তা ক্রমশই বাড়ছে।
সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা দ্বিতীয় বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে অভ্যুত্থানকারীদের ওপর। সেখানে সরকারবিরোধীদের ওপর প্রথম বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে বর্তমান প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা। এ অবরোধ এবং হুমকি-ধমকির ফলে আরব বিশ্বের আরেকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধ যে শুধু আরব বিশ্বের বিরুদ্ধে তাই নয়, সিরিয়ার যেসব নিরপরাধ জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে।
মার্কিন কূটনীতিতে রবার্ট ফোর্ড একজন ব্যর্থ পিয়ন মাত্র। তাকে ছিনতাই করার ঘটনা তাকে শুধু গণমাধ্যমের আকর্ষণে পরিণত করেছে এবং খুব বেশি হলে এ নিয়ে তিনি একটা বই বের করতে পারবেন। কিন্তু এটা সিরিয়ার অভ্যুত্থানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অতোটা স্পষ্ট হবে না। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সিরিয়ার জনগণই নির্ধারণ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, আক্টোবর ০৬, ২০১১