কিন্তু এই চলতি ধাঁধার চেয়েও বড় চমকের খবর দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল। তারা বলছে, জুনে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্সের আসনে বসানোর চেয়ে বড় চমক আগামী সপ্তাহেই দেবেন বাদশাহ।
মাত্র পাঁচ মাসেরও কম সময়ে এই পরিবর্তন যদি হয়, তবে সৌদি রাজসিংহাসনের ইতিহাসে এটি হবে বিরল ঘটনা। কারণ, ১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের হাত ধরে সৌদি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর যে ক’জন বাদশাহ ক্ষমতায় ছিলেন, কেউই এতো কম সময়ে বাদশাহী ছাড়েননি। এর আগে সবচেয়ে কম সময় মাত্র ৭ বছর বাদশাহীতে ছিলেন ১৯৭৫ সালে সিংহাসনে বসা খালিদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
সূত্রের বরাত দিয়ে দিয়ে ডেইলি মেইল বলছে, ৩২ বছর বয়সী ছেলেকে বাদশাহ ঘোষণার পর ৮১ বছর বয়সী সালমান আনুষ্ঠানিক কোনো পদবি ধরে রাখবেন কেবল। অর্থাৎ কার্যত নেতৃত্ব চলে যাবে মোহাম্মদের হাতে, আর তার পেছনে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো কোনো আনুষ্ঠানিক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন সালমান।
সংবাদমাধ্যমটির সূত্র অনুযায়ী, নাটকীয় কিছু না ঘটলে সামনের সপ্তাহেই এই বড় পরিবর্তন দেখবে বিশ্ববাসী। যেটা অনুমান করা হচ্ছে, বাদশাহ সালমান মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন।
গত ২১ জুন এক আকস্মিক রাজকীয় অধ্যাদেশে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে বাদশাহ-পুত্রকে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ এর আসনে বসানো হয়। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে পদোন্নতির পাশাপাশি মোহাম্মদ বিন নায়েফ একইসঙ্গে সৌদি আরবের উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। আগে থেকেই সামলে আসা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
তাকে এতো ক্ষমতা দেওয়ায় স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয় যে, কার্যত সৌদি চালাবেন মোহাম্মদ বিন সালমান। সালমান থাকবেন কাগজে-কলমে ‘বাদশাহ’। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পরই মোহাম্মদের পদক্ষেপ ঝড় তুলতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
ইয়েমেনের সুন্নি নেতৃত্বকে রক্ষায় সেখানকার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সৌদি আরও আগ্রাসী হয় তার নেতৃত্বে। দেওয়া হয় নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি এবং তাদের সপরিবারে স্টেডিয়ামে ঢোকার ঘোষণা। তার নেতৃত্বে ইরান, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের পড়শী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে আরও আত্মমুখী এবং আরও আক্রমণাত্মক হয় সৌদি আরব। সম্প্রতি মোহাম্মদেরই নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ৪০ জনেরও বেশি প্রিন্স এবং সরকারের বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হলে তার ক্ষমতার ‘পূর্ণ ব্যবহারের’ বিষয়টি চোখে পড়ে।
ডেইলি মেইলের খবর অনুযায়ী, এই ‘ক্ষমতা চর্চা’ আড়ালে থেকে না করে এবার আনুষ্ঠানিক পদবি নিয়ে করবেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
সংবাদমাধ্যমটির শীর্ষ পর্যায়ের সূত্র বলছে, বাদশাহর আসনে বসলেই মোহাম্মদ মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি সাম্রাজ্যের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে কোণঠাসা করার দিকে মনোযোগ দিবেন। এমনকি যেটা সামরিক পদক্ষেপের দিকেও এগোনোর ঝুঁকি আছে। ইরানের সমর্থনপুষ্ঠ লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন শিয়াপন্থি হেজবুল্লাহকে দমনেও এগোতে পারেন তিনি। সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইসরায়েলকে পর্যন্ত পক্ষে টানতে পারেন মোহাম্মদ বিন সালমান। কারণ, সৌদির সমরবিদরা জানে, হেজবুল্লাহকে দমনে আঞ্চলিকভাবে ইসরায়েল ছাড়া কারও স্বার্থের প্রশ্নে সামরিক সহযোগিতার সুযোগ কম।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমানকে বোঝানো হয়েছে যে, সৌদি আরবকে নিজেকে সুরক্ষিত ও সমুন্নত জাতি হিসেবে রাখতে হলে তাদের ইরান ও হেজবুল্লাহকে আঘাত করতে হবে। রাজপরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা এ বিষয়ে সাবধানবাণী দিলেও মোহাম্মদের পরবর্তী পদক্ষেপ এই দুই শক্তিকে ঘিরেই। যেজন্য কুয়েতের শাসকগোষ্ঠী তাকে গোপনে ‘বেপরোয়া ষাঁড়’ বলে ডেকে থাকে।
সম্প্রতি রিয়াদের আকাশে তেহরানের সমর্থনপুষ্ট ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং তারপর রিয়াদ থেকে সম্প্রচারিত টেলিভিশন ভাষণে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরির পদত্যাগ ঘোষণার পর ইরান-হেজবুল্লাহর সঙ্গে সৌদির দ্বন্দ্বের বিষয়টি আরও সামনে আসে। সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে দু’পক্ষকেই হুঁশিয়ারি করে বলা হয়, লেবাননের রাজনীতিতে তেহরান অযথা নাক গলাচ্ছে। হুথিদের তারাই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। সৌদির সঙ্গে ‘যুদ্ধের মতো আচরণ’ করছে ইরান। জবাবে তেহরান ও হেজবুল্লাহ পাল্টা হুঁশিয়ারি দেয় সৌদিকে।
এ বিষয়ে রিয়াদের বাদশাহ ফয়সাল গবেষণা ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষাবিদ জোসেফ এ. কেচিচিয়ান বলেন, মোহাম্মদ বিন সালমান এমন এক তরুণ, যিনি নিজে মরণখেলা খেলতে চান না। কিন্তু আপনি তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়লে তিনি জবাব দেবেন।
পর্যবেক্ষকদের শঙ্কা, মোহাম্মদ বিন সালমান বাদশাহীতে বসলে তাকে যদি বোঝানো হয় যে, ইরান ও হেজবুল্লাহ সৌদির জন্য চ্যালেঞ্জ, তবে রাজপরিবার ও রিয়াদের রাজনৈতিক বলয়ে যে ঝড় বইছে, তার লেজ ঘুরবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও রণাঙ্গনেও।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৭
এইচএ/