পেছনে ফিরে তাকালে মৌলবাদ, রাজনৈতিক বিভাজন, গুজরাট দাঙ্গার মতো অনেক গুরুতর অভিযোগ ও ঘটনার মধ্য দিয়ে এতোদূর আসতে হয়েছে বিজেপিকে। যদিও এখন বিজেপির ‘গেরুয়া ঝাণ্ডা’ উড়ছে দিল্লি থেকে শুরু করে সেই উত্তর-পশ্চিমের জম্মু-কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বের অরুণাচল পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টিই চলছে তাদের নেতৃত্বে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতজুড়ে ‘ডিজিটালাইজেশন’ ও ‘উন্নয়ন’র যে জোয়ার চলছে, তাতে গা না ভাসানোর ‘বিকল্প’ নেই দেশের মানুষের কাছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতে, দলের পক্ষে দেশজুড়ে যে বিজয়ধ্বনি উঠেছে, তা ক্রমেই জোরালো থেকে জোরালোতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগানে মোদী যে উন্নয়নযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেটা ভারতকে পরিণত করবে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে।
আনুষ্ঠানিক যাত্রা
আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল। তবে এ দলের উৎস ১৯৫১ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনসংঘ। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে জনসংঘ একাধিক রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জনতা পার্টি গঠন করে। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি অবলুপ্ত হলে বিজেপি গঠন করেন জনসংঘের নেতারা। প্রতিষ্ঠাকালীন বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব পান অটল বিহারী বাজপেয়ী। বৃহৎ জনসমর্থন আদায়ে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার প্রচারণা চালায় বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন দল।
লোকসভার নেতৃত্ব
১৯৮৪ সালে নিজেদের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুই আসন পায় বিজেপি। এতে ভেঙে পড়ে নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক মনোবল। তবে দলের আদর্শ ‘একাত্ম মানবতাবাদ’ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ‘কোমর বেঁধে’ নামেন বিজেপির নেতারা। এর ফলও পায় দলটি। ১৯৮৯ সালের পরবর্তী নির্বাচনে ৮৫ আসন পায় বিজেপি। সমর্থন দেয় জন মোর্চাকে। তাদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।
১৯৯০ এর দশকে অযোধ্যায় (বিতর্কিত এক স্থানে রামের জন্মভূমি ধরে মন্দির গঠনের দাবিতে) ‘রাম জন্মভূমি আন্দোলন’ শুরু হলে শক্তি বাড়ে বিজেপির। ওই আন্দোলন প্রশ্নে বিজেপি বিশ্বনাথের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। শেষে তিনি পদত্যাগ করেন। হিন্দুত্ববাদী ওই আন্দোলনে বিজেপির অবস্থানের কারণে দলটি সেসময় একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জয় পায়। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে পায় ১২০ আসন। এরপর ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লোকসভায় ১৬১ আসন জিতে পায় বৃহত্তম দলের মর্যাদা। যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে ১৩ দিনের মাথায় ক্ষমতা হারাতে হয় বাজপেয়ীর বিজেপিকে।
১৯৯৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে তাতে জয় পায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ। সে জোট সরকার গঠন করে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে। এ জোট থেকে এআইএডিএমকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ভেঙে যায় সরকার। ফের ১৯৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজেপি পায় ১৮২ আসন, তাদের এনডিএ জোট পায় ৩০৩ আসন। বাজপেয়ীর নেতৃত্বেই গঠন হয় সরকার। এই সরকার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে। এটিই ছিল ভারতে প্রথম পূর্ণ মেয়াদের অ-কংগ্রেস সরকার।
২০০৪ সালের নির্বাচনে ফের হেরে যায় বিজেপি জোট। বাজপেয়ীর দল পায় ১৩৮ আসন। এ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস। এরপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আবারও হেরে বসে এনডিএ জোট। এবার লোকসভায় আসন আরও কমে যায় বিজেপির, পায় ১১৬ আসন।
১০ বছর বিরোধী দলে থাকার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় বিজেপির জোট, পায় ৩৩৬ আসন, যেখানে গেরুয়াদের আসনসংখ্যা ২৮২। এ নির্বাচনে জয় পেয়ে বিজেপির গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নরেন্দ্র মোদী। গুজরাটের ‘রেলওয়ে স্টেশনের চা বিক্রেতা’ থেকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে ওঠা এই মোদীর নেতৃত্বে এখন দিল্লির মসনদ ছাড়াও বিজেপি দখল করছে রাজ্যগুলোর সরকারের গদিও। শেষ হিসাব মতে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টিরই সরকার চালাচ্ছে ‘গেরুয়া পতাকাধারীরা’।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল
২০১৫ সাল পর্যন্ত চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিলো। কিন্তু উইকিপিডিয়ার মতে, ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিজেপির প্রাথমিক সদস্যপদই পৌঁছে গেছে ১০ কোটি পর্যন্ত, যা গত তিন বছরে আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। আর দলের প্রাথমিক সদস্যপদই যদি ১০ কোটি হয়, তাহলে সমর্থনের দিক থেকে সর্ববৃহৎ দলই হওয়ার কথা বিজেপির।
সদস্যভুক্তিতে ২০১৪ সালে অভিনব প্রচারণা চালু করেন বিজেপির বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ। ‘মিসড কল’ নামে ওই কর্মসূচির আওতায় কেউ মিস কল দিলেই বিনা খরচে বিজেপির সদস্য হয়ে যেতে পারতো, দলের পক্ষ থেকে ফোন করে নিয়ে নেওয়া হতো সদস্যভুক্তির যাবতীয় তথ্য।
অবশ্য বিজেপিপন্থি বিশ্লেষকরা এই সদস্যসংখ্যাকেই দলের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি মানতে চান না। তারা তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব নরেন্দ্র মোদীর ঊর্ধ্বমুখী ইতিবাচক প্রভাব ও রাজ্যগুলোতে বিজেপির ক্রমাগত ভালো ফলাফলকে দেখছেন দলের শক্তির পরিচয় হিসেবে।
বিধানসভাগুলোতে বিজেপির অবস্থান
৫৪৫ আসনের লোকসভায় বিজেপির বর্তমান জোটতো (৩৩৬) নেতৃত্ব দিচ্ছেই, ২৯ রাজ্যের ২০ বিধানসভাও চালাচ্ছে বিজেপি বা তাদের জোট।
বর্তমানে সরাসরি ১৫টি রাজ্যে বিজেপি সরকারের মনোনীত নেতা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। রাজ্যগুলো হলো- অরুণাচল, আসাম, চত্তিশগড়, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মনিপুর, রাজস্থান, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড।
আর জোট গড়ে বিজেপি ক্ষমতা ভাগাভাগি করছে পাঁচ রাজ্যে। সেগুলো হলো বিহার, জম্মু-কাশ্মীর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও সিকিম।
এছাড়া আরও বেশ কিছু রাজ্য ও কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে রাজনৈতিক ময়দান পোক্ত করছে বিজেপি।
যদিও বিজেপির দুই দশকেরও বেশি সময়ের মিত্র শিবসেনা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানার আঞ্চলিক প্রভাবশালী দল তেলেগু দেশম পার্টিও (টিডিপি) এনডিএ জোট ছেড়ে গেছে, তবু দিল্লির মসনদে থাকা দলের নেতৃত্ব এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। বরং ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর ভারতজুড়ে যে ‘মোদী জাদু’ দেখা যাচ্ছে, সেটাকে ‘শক্তি’ বানিয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনেও হাসাতে চায় ‘পদ্মফুল’কে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৮
এইচএ/