সত্যিই শান্তিকামী বিশ্ববাসীর হৃদয় জিতে নিয়ে প্রয়াত হয়েছেন কফি আনান। শান্তিতে নোবেলজয়ী জাতিসংঘের সাবেক এ মহাসচিব শনিবার (১৮ আগস্ট) সকালে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
১৯৯৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জাতিসংঘ মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালনের ফলে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় থাকলেও কফি আনান আসলে তার গোটা জীবনেরই বেশিরভাগ সময় কাজ করেছেন বিশ্বশান্তির জন্য। সে কথাই উল্লেখ করা হয় কফি আনান ফাউন্ডেশনের বিবৃতিতে, ‘তিনি ছিলেন বৈশ্বিক কূটনীতিক ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আন্তর্জাতিকতাবাদী। নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের কথাই আগে ভেবেছেন তিনি, যা করেছেন- সবকিছুতেই ছড়িয়েছে সত্যিকারের মমতা, আন্তরিকতা আর মেধার দ্যুতি। জাতিসংঘ থেকে অব্যাহতির পরও তিনি কফি আনান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য এল্ডার্স’র প্রধান হিসেবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে গেছেন। ’প্রাথমিক জীবন
কফি আনান ১৯৩৮ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ঘানার কুমাসি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা উভয়ের পরিবারই উপজাতি গোষ্ঠীর শীর্ষ পর্যায়ের পরিবারের সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে বাবা ছিলেন আবার শিক্ষিত। সে হিসেবে উপজাতীয় ও আধুনিক-উভয় সংস্কৃতি গায়ে মেখেই বড় হন আনান।
ঘানার একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কুমাসির কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন। ২০ বছর বয়সে স্কলারশিপ পেয়ে আনান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ম্যাসালেস্টার কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে দক্ষ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আনান যেন বিশ্বজয়ী কূটনীতিক হওয়ার জানান দিচ্ছিলেন।
১৯৬১ সালে তিনি ওই কলেজ থেকেই অর্থনীতি উচ্চতর ডিগ্রি নেন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার পাঠ চুকে আনান চলে যান সুইজাল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে তিনি গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনশ্যানাল অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট স্টাডিজে অর্থনীতির ওপরই আরেকবার স্নাতক ডিগ্রি নেন।
কর্মজীবনের শুরু
জেনেভায় পড়াশোনার পর আনান জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (হু) যোগ দেন। সেসময় সংস্থাটিতে প্রশাসনিক ও বাজেট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাকে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে পদায়ন করা হয়। আনান বরাবরই মাতৃভূমিতে ফিরতে চাইলেও আফ্রিকান দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে বারবার দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।
এরমধ্যে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আলফ্রেড পি. স্লোয়ানে ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ফেলোশিপটি শেষ করার পর আনানকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়। পরে ঘানায় ফেরার বদলে তিনি নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদরদফতরে চাকরিতে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালে আনান জাতিসংঘ ইমারজেন্সি ফোর্সের চিফ সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে কায়রোতে পদায়ন লাভ করেন। তবে সে বছর ওই দায়িত্ব ছেড়ে ঘানায় গিয়ে দেশটির পর্যটন উন্নয়ন কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে যোগ দেন।
এরপর আনান আবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘে যোগ দেন। সাত বছর তিনি জেনেভায় জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনে (ইউএনএইচসিআর) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদফতরে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অফিসে বাজেট পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই দশকের শেষ দিকে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা সমন্বয়ক পদে কাজ করেন। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের অফিস অব প্রোগ্রাম প্ল্যানিং, বাজেট অ্যান্ড ফিন্যান্সের সহকারী মহাসচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন আনান। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা থেকে ব্যবস্থাপনা, সবক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এমনকি ১৯৯০ এর দিকে কুয়েত যুদ্ধের সময় ইরাক থেকে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্যও মধ্যস্থতা করেছিলেন আনান।
জাতিসংঘ মহাসচিব পদে নিয়োগ
এতো বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান দেখিয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সংস্থার মহাসচিব পদে নিয়োগ পান আনান। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। এতো বড় পদে দায়িত্ব পেলেও আনান তার অতীত ক্যারিয়ারের মতোই ছিলেন নরমভাষী। এই নরম ভাষায়ই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছিলেন তিনি।
প্রথম মেয়াদে জাতিসংঘের কার্যক্রমে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় আনানকে ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় জাতিসংঘ মহাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে জাতিসংঘের সঙ্গে আনানকেও যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
ওই পুরস্কার প্রদানের কারণ হিসেবে তখন নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আনান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা সংস্থাকে নতুন রূপ দিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় আরও বেশি তৎপর করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং এইডসের মতো দুরারোগ্য রোগের প্রতিরোধে তার কার্যকর পদক্ষেপই জাতিসংঘকে বিশ্ববাসীর দরবারে আরও সম্মানিত করেছে।
শান্তির জন্য প্রচেষ্টা
কফি আনান ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে প্রয়াত এ নেতার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি তার কর্মজীবনে সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে নাইজেরিয়ায় বেসামরিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তার প্রচেষ্টা দেশটির জনগণ আরও স্মরণ করেন। সাদ্দাম হুসেইন সরকারের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে অভিযোগ ওঠার পর ইরাকের সঙ্গে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, সেটা কিছুটা প্রশমিত হয় তার বাগদাদ সফরের মধ্য দিয়েই। সেসময় যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হলেও তার আশ্বাসেই ইরাক পশ্চিমা শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়। ১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার কার্যকর ভূমিকার কারণেই ২০০০ সালে লেবানন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৬ সালে হেজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর লড়াইও থামে আনানের হস্তক্ষেপে। বাকাসি উপদ্বীপের মালিকানা নিয়ে নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনের মধ্যে যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তারও সমাধান বের করেন আনান।
জাতিসংঘ মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতির পরও কফি আনান শান্তির বিশ্ব গড়তে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এরই অংশ হিসেবে তিনি ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন কফি আনান ফাউন্ডেশন। ‘শান্তির পথে’ স্লোগানে যাত্রা করা এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নিজের দ্যুতি ছড়াতে থাকেন আনান।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এর সুরাহার জন্য ২০১২ সালে তাকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেয় জাতিসংঘ ও আরব লিগ। দীর্ঘ সময় চেষ্টা চালিয়েও কোনো ফল না মেলায় হতাশ হয়ে সরে দাঁড়ান আনান।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের মুখে রোহিঙ্গা সংকটের শুরু হলে সমস্যার সমাধান বের করতে দেশটির সরকারের সঙ্গে মিলে একটি যৌথ কমিশন গঠন করেন কফি আনান। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তার নামে গঠিত আনান কমিশন রাখাইনের অস্থিতিশীলতার স্থায়ী সমাধানে ৮৮ দফা সুপারিশ দেয়। যেখানে ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিরাপদে (বাংলাদেশ থেকে) প্রত্যাবাসনের বিষয়াদি। এই সুপারিশমালাকে যৌক্তিক হিসেবে অভিহিত করে তা বাস্তবায়নের জন্য সেসময় থেকে আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অবশ্য জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার আগে সংস্থাটির শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধান থাকাকালে কয়েকবার সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন আনান। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় প্রায় ৮ লাখ উপজাতিকে হত্যা এবং ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় সার্বিয়ান বাহিনীর হাতে ৮ হাজার মুসলিম হত্যার ঘটনায় তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বলা হয়, আগে হুঁশিয়ারিবার্তা পাওয়া সত্ত্বেও আনানের খামখেয়ালিতে স্থানীয় শক্তি ওই মানুষগুলোকে হত্যার সুযোগ পেয়েছে। যদিও এসবের ক্ষেত্রে আনান বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা না পাওয়ার কথা বলেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে গেছেন।
শান্তির দূতের প্রস্থানে শোকাহত বিশ্ব
বিতর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রসেনানী খেতাব নিয়েই শেষ শ্বাসটি ফেলতে পারলেন কফি আনান। তার মৃত্যুতে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব উত্তরসূরীকে ‘ভালোর পথের দিশারী শক্তি’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘নানাভাবে কফি আনান নিজেই ছিলেন জাতিসংঘ। একেবারে শেকড় থেকে সংস্থাটিকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি অনন্য সম্মান ও সংকল্পের মাধ্যমে নতুন সহস্রাব্দের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। ’
শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আদ্দো, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফসহ বিশ্বনেতারা।
আর আনান ফাউন্ডেশন বিবৃতিতে শোক জানিয়ে বলেছে, ‘তিনি সবসময় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৮
এইচএ/