প্রাণিজগতের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজনে ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এগুলোকে প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইসলাম।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রাণিকূল সৃষ্টির (অন্যতম) কারণ হলো, এগুলোতে তোমরা আরোহণ করে থাকো আর এগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক। ’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮)
প্রাণিজগতকে পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো একেক জাতি।
’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৩৮)
প্রাণিজগত সতত মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। আল্লাহ তাআলা কুদরতিভাবে এগুলোকে মানুষের করায়ত্ত করে রেখেছেন। প্রাণীরা অবশ্যই করুণা ও মমতা পাওয়ার যোগ্য। ইসলাম পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করার শিক্ষা দেয়। পশু-পাখির যথেচ্ছ ব্যবহারে নিষেধ করে। ইসলামে পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫১৯৫)
পশু-পাখিকে আল্লাহর জমিনে অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি মেরে ফেলল, কিয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে। ’ (নাসায়ি, ইবনে হিব্বান)
প্রাণী প্রতিপালন করলে, সেগুলোর সুস্থতা ও খাবারদাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব বা অত্যাবশকীয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘এসব বাক্শক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৫৪৮)
অগণিত প্রাণীর মধ্যে ইসলাম সীমিত কিছু পশু-পাখি খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো জবাই করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অনুকম্পা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা জবাই করবে, সর্বোত্তম পন্থায় করবে। জবাইয়ের বস্তু ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে, আর পশুটির প্রাণ স্বাভাবিকভাবে বের হওয়ার সুযোগ দেবে। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৯৫৫)
তাই ফিকাহবিদরা লিখেছেন, জবাই করার জন্য পশুদের টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা যাবে না। পরিপূর্ণ নিস্তেজ হওয়ার আগে ছুরিকাঘাত কিংবা চামড়া সরানো যাবে না। এসব কাজ মাকরুহে তাহরিমি।
কোনো জীবন্ত পশু-পাখি আগুনে পোড়ানো ইসলামে নিষিদ্ধ। আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ (রা.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, এক সফরে আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলাম। তিনি দেখতে পেলেন, আমরা একটা মৌমাছির বাসা জ্বালিয়ে দিয়েছি। মহানবী (সা.) বললেন, ‘কে এটি জ্বালিয়ে দিয়েছে?’ আমরা নিজেদের কথা বললাম। তিনি বলেন, ‘আগুনের স্রষ্টা ছাড়া কারো জন্য আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া শোভা পায় না। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৬৭৫)
ফিকাহবিদরা বলেন, পিঁপড়া দংশন না করলে তাদের মেরে ফেলা মাকরুহ। আর এদের পানিতে নিক্ষেপ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। বিচ্ছুকেও আগুনে পুড়ে ফেলা মাকরুহ। ’ (ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া, ৬/৩৭০)
জীবিত থাকা অবস্থায় পশু-পাখির কোনো অঙ্গ কাটা যাবে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয়, সেটা মৃত তথা হারাম হয়ে যাবে। ’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৪৮০)
পশু-পাখির চেহারায় প্রহার করা, অঙ্কিত করা ও চিহ্ন ব্যবহার করে চেহারা বিকৃত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) চেহারায় প্রহার ও অঙ্কন করতে নিষেধ করেছেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ২১১৬)
ইমাম নববি (রহ.) লিখেছেন, ‘যেকোনো প্রাণীর চেহারায় আঘাত করা নিষিদ্ধ। ’
আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রকৃতির সৌন্দর্য হিসেবে পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা থাকা চাই। এগুলোকে কোনো কারণে অশুভ মনে করা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। এমনকি পেঁচা বা সফর মাসেও কোনো কুলক্ষণ নেই। ’ (বুখারি)
অহেতুক পশু-পাখির পেছনে লেগে থাকা, অযথা এগুলোকে শিকার করা ইসলামে নিন্দনীয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৯৫৭)
সাইদ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হজরত ইবনে ওমর (রা.) কোরাইশ গোত্রের একদল বাচ্চাকে দেখতে পেলেন যে তারা পাখি শিকার করছে। এটা দেখে ইবনে ওমর (রা.) তাদের সরিয়ে দেন এবং বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যেকোনো প্রাণবিশিষ্ট বস্তুকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৯৫৮)
তাই আসুন, সব ধরনের প্রাণীর প্রতি সদয় ও স্নেহশীল হই। তাদের জন্য ভালোবাসা ও মমতা লালন করি এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য রক্ষায় মনোযোগী হই।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৩
এএটি