ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

দেনমোহর ইসলাম নির্ধারিত নারীর অধিকার 

তাযকিরা খাতুন রিনি, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২৩
দেনমোহর ইসলাম নির্ধারিত নারীর অধিকার 

দ্বীন-ধর্মকে ভালোবাসেন এবং নামাজ-রোজা করেন এমন অনেক মানুষও মোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে উদাসীনতা এত প্রকট যে, অনেকে নফল নামাজ পড়াকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকি ভাগও মনে করেন না।

অথচ তা একটি ফরজ বিধান ও বান্দার হক, যা আদায় করা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দ্বীনদার হতে পারে না। এ জন্য প্রথমেই দরকার মোহরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। এরপর তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।

বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করতে হবে; এটা স্বামী কর্তৃক প্রদেয় স্ত্রীর জন্য ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত অধিকার বিশেষ। দেনমোহর আদায় করা ফরজ এবং এটা বিয়ে বৈধ করার মাধ্যমও বটে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে দেনমোহর নামেমাত্র নির্ধারণ করা হয়। অনেকটা যেন নিয়ম রক্ষার বিষয়! বিয়ের কাবিননামার ফরমে দেনমোহরের পরিমাণ লিখতে হয় তাই লেখা! হাতেগোনা কয়েকজন বাদে বিয়েবিচ্ছেদজনিত কারণ ছাড়া স্ত্রীকে খুশি মনে দেনমোহর প্রদান করেছেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

সমাজের অনেকেই দেনমোহরকে নারীর বৈবাহিক জীবনের একটি ‘বন্ড’ মনে করে থাকেন। এ ধারণা একেবারেই অমূলক। বিয়েতে দেনমোহর প্রদান প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমের সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের মোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে। ’

এ আয়াতের আলোকে বলা যায়, আল্লাহর নির্দেশেই স্ত্রীকে মোহর দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বিয়ের সময়ই স্ত্রীকে মোহর পরিশোধ করার বিধান। স্বামী তার আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী মোহর দেবে। স্ত্রী মোহর হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক হয়েই স্বামীর সঙ্গে সংসারযাত্রা শুরু করবে। স্বামী কর্তৃক প্রাপ্ত এই সম্পদ একান্তভাবে স্ত্রীর। এখানে অন্য কারো কোনো অধিকার নেই। স্ত্রী ইচ্ছে করলে প্রাপ্ত মোহর থেকে স্বামীকে কিছু অংশ দিতে পারে বা অন্য কাউকে কিছু দান করতে পারে, এটা স্ত্রীর ব্যক্তিগত অধিকার এবং স্বাধীন ইচ্ছা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সমাজ থেকে যেন দেনমোহর আদায়ের প্রথা দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিয়ের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি স্ত্রীকে মোহর প্রদানের আদৌ কোনো ইচ্ছা বা নিয়তই থাকে না, তার সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি মোহর ধার্য করে বিয়ে করল; অথচ তার অন্তরে মোহরের সে হক আদায়ের আদৌ কোনো ইচ্ছাই নেই, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে। ’ তাবারানি

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মোহর আদায়ের ব্যাপারে শুরু থেকেই খারাপ নিয়ত রাখে, সে মোহরের মৌখিক স্বীকৃতি দিল বটে কিন্তু তার অন্তরের অবস্থা হলো, মোহর দেওয়া-নেওয়ার কোনো বিষয় নয়। করতে হয়। তাই করলাম। ফলে বিয়ের মধ্যেই অনেক বড় অসম্পূর্ণতা চলে আসে এবং এ ধরনের ব্যক্তি এমন পাপী হয় যে, কিয়ামতের দিন তাকে ব্যভিচারের অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে।

মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে বৈধ হয় ৫টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। মোহর প্রদান সেই ৫ শর্তের অন্যতম একটি শর্ত। মোহর প্রদান ছাড়া বিয়ে পুরোপুরি বাতিল না হলেও এ ধরনের বিয়ে ত্রুটিযুক্ত।

বিয়ের সময় যদি মোহর নির্ধারিত নাও হয়ে থাকে, এমনকি স্ত্রী কোনো মোহর দাবি করবেন না শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হয়- তাহলেও স্ত্রীকে মোহর দিতে হবে। স্বামী কোনো অজুহাত দেখিয়েই স্ত্রীকে মোহর দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবেন না।

মোহর নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ অজ্ঞতা ও কুপ্রথা চালু আছে। সমাজের অনেক নারীই মোহরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত নন। ফলে তারা খুব সহজেই মোহর থেকে বঞ্চিত হন। স্বামী মারা গেছেন বা কোনো কারণে তালাক দিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে বা দেখার মতো কেউ নেই কিংবা থাকলেও কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। এ ধরনের সংকটকালে কোনো নারীকে যেন পথে নামতে না হয়, এ জন্য ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার প্রদান করেছে- এর মধ্যে অন্যতম হলো মোহর। এটি নারীর অগ্রিম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সংকটকালে এর মাধ্যমে সম্মানজনক জীবনযাপনের একটি সুন্দর ও অর্থবহ ব্যবস্থা। এ সম্পর্কে প্রতিটি নারীর সচেতনতা ও যথাযথ জ্ঞান থাকা দরকার।

মোহর নারীর আইনসম্মত অধিকার। একই সঙ্গে এ জায়গাটিতে স্বামীদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তারা তাদের দায়িত্ব আদায় করলে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অধিকার সংরক্ষিত হবে।

মোহর নিয়ে সমাজে প্রচলিত জঘন্য কুপ্রথাটি হলো, বিয়ের প্রথম রাতেই স্ত্রীর কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মোহর মাফ করিয়ে নেওয়া। বাসর রাতে যে কোনো নারীই মানসিকভাবে দুর্বল থাকেন। এছাড়া মোহরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানা না থাকায়; স্বামী যখন তার কাছে মোহর মাফ চান, তখন তাকে ‘না’ বলার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন না। মোহর নিয়ে এমন নাটক করতে পবিত্র কোরআন ও ইসলামি শরিয়ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।

লোক দেখানো মাত্রাতিরিক্ত মোহর ধার্য করে তা পরিশোধ না করার জন্যই মানুষ এ কুপ্রথার আশ্রয় নেয়। এ প্রথা নির্মূলের জন্যই ইসলাম মোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থান ও স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় রাখতে বলেছে। মোহর এত অধিক হওয়া উচিত নয়- যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়।

বিয়ের সময় মোহর প্রদানের প্রথা শুধু ইসলাম ধর্মেই রয়েছে। এটি কন্যা পণও নয় বা বর পণও নয়। ইসলাম মোহর প্রদানকে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাস্বরূপ অবশ্য প্রদেয় বিষয় বলে নির্ধারণ করেছে। এটা নিয়ে কোনো ছলচাতুরীর অবকাশ নেই। যারা এমনটি করেন, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ঘোষণা।

মোহরের অর্থ থেকে নারীকে ঠকানো বিষয়ে ইসলামি চিন্তাবিদদের পরামর্শ হলো, স্বামীর পক্ষে পরিশোধ সম্ভব এমন অঙ্কের মোহর ধার্য করা। অন্য দশটা ঋণের মতো এই ঋণ পরিশোধের বিষয়ে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বহু নির্দেশনা এসেছে- তা পালন করা। নারীর সম্মান ও পাওনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এটাকে কোনোভাবেই পোশাকি কোনো চুক্তি বা রেওয়াজ মনে না করা।

বরের বিয়ে ও বিয়ে প্রস্তুতির পুরো বাজেটে মোহরের টাকাটা আবশ্যকীয় মনে করা। বিয়ের ক্ষেত্রে প্রাক বিয়ের খরচ থেকে শুরু করে, কার্ড ছাপানো, বিয়ের বাজার, ওলিমার জন্য প্রস্তুতি, কমিউনিটি সেন্টার বুকিং, বরযাত্রায় গাড়ি ভাড়া, সেলামির অর্থ জোগাড় রাখার সঙ্গে সঙ্গে মোহরের টাকার বিষয়টা মাথায় রাখলে- মোহরের টাকা পরিশোধ করা অনেক সহজ হয়ে যাওয়ার কথা।

শেষ কথা হলো, মোহরকে অবশ্য আদায়যোগ্য ওয়াজিব আমল মনে করলে, সামর্থ্য সীমিত থাকলেও তা আদায়ের উপায় বের হয়ে আসবে- ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মুসলমানকে মোহর আদায়ের উদাসীনতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২৩
এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।