ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

জিলহজ একটি সম্মানিত মাস

মাওলানা ইউসুফ নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪
জিলহজ একটি সম্মানিত মাস

ইসলামী বর্ষের সর্বশেষ মাস জিলহজ। পবিত্র মাসটির প্রথম দশক অত্যন্ত বরকতময় ও গুরুত্বপূর্ণ।

এ দশকের রজনীগুলো মুসলিম উম্মাহর জন্য নেকি ও পূণ্য অর্জনের শেষ মৌসুম বলা চলে। আল্লাহ প্রদত্ত এ সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা মুসলমানদের দায়িত্ব।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এগুলোতে তোমরা নিজের প্রতি (পাপাচারের মাধ্যমে) অবিচার করো না। (সুরা তওবা: ৩৬)

সম্মানিত মাসগুলোর বর্ণনা দিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি অবিচার করো না।

কুরআনের বাক্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে মাসগুলোর এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার ফলে এতে ইবাদত করা হলে বছরের বাকি মাসগুলোতে তওফিক ও সাহস করা যায়। অনুরূপ এ মাসগুলোতে পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে বছরের অন্যান্য মাসগুলোতেও পাপাচার থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। তাই এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থাকা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। আহকামুল কুরআন

স্বাগতম মাহে জিলহজ
জিলহজ মাসের প্রথম দশককে ইবাদতের ঈমানি আবেগ দিয়ে বরণ করে নেওয়া পূণ্যের প্রথম ধাপ। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো:

১. তওবা: ইবাদতের রজনীগুলোকে তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে হয়। তওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় ও ইবাদতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তওবা দুনিয়ার উন্নতি ও আখেরাতের মুক্তির চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (আন নুর: ৩২)

২. ইবাদতের দৃঢ় সংকল্প: রজনীগুলোতে ইবাদত করার দৃঢ় সংকল্প থাকা চাই। ভালো কথা বলার ও ভালো কাজ করার অদম্য আগ্রহ থাকলেই আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। যে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হবে আল্লাহ তার জন্য আমলের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন। এরশাদ হচ্ছে, যারা আমার জন্য সাধনা করে আমি তাদের অবশ্যই আমার পথপ্রদর্শন করবো। আল্লাহ পূণ্যবানদের সঙ্গেই আছেন। (সুরা আনকাবুত: ৬৯)

৩. গুনাহ না করা: কল্যাণের এ দিনগুলোতে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া নিজের ওপর চরম অবিচার করার শামিল। গুনাহের কারণে আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসে। তার দয়া ও করুণা বন্ধ হয়ে যায়। পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি ইবাদত ও নেক আমলের অনুরাগ হারিয়ে ফেলে। আপাদমস্তক পাপাচারে নিমজ্জিত থেকে মুক্তির আশা করা বাতুলতা মাত্র। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, গুনাহের কারণে আল্লাহর আজাব নিপতিত হয়।

ফজিলতপূর্ণ দশক
জিলহজের প্রথম দশক অনন্য মর্যাদা ও অশেষ ফজিলতপূর্ণ।
১. আল্লাহ এ দিনগুলোর শপথ করেছেন। তিনি বলেন, শপথ ফজরের, শপথ ১০রাতের। সুরা আলফজর: ১২।

অধিকাংশ তাফসিরবিদের মতে, এখানে জিলহজের প্রথম ১০দিনের কথা বলা হয়েছে। ইমাম ইবনে কাসির বলেন, এটাই বিশুদ্ধতম মত।

২. আল্লাহকে স্মরণ করার রজনীগুলো। হজ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, যাতে নির্ধারিত দিনগুলোতে তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। সুরা হজ: ২৮। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমরসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ তাফসিরবিদের মতে, নির্ধারিত দিনগুলো দ্বারা জিলহজের প্রথম ১০দিন বোঝানো হয়েছে।

৩. পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দশক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলো হলো জিলহজের প্রথম দশক। ইবনু হিব্বান

৪. আরাফার দিন। নয় জিলহজ। আরাফার দিন। আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কাছে আরাফার দিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোনো দিন নেই। ইবনে হিব্বান। আরাফার দিন মহামুক্তির মহান দিবস। মুমিনের কাঙ্ক্ষিত দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আরাফার দিন হতে অধিক বান্দাকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি এদিন বান্দার খুব কাছে চলে আসেন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়?

শুধু আরাফার দিনের বৈশিষ্ট্য, মর্যাদা ও ফজিলতের ব্যাপারে আলোকপাত করার জন্য স্বতন্ত্র রচনার প্রয়োজন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, জিলহজের প্রথম দশকের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য আরাফার দিনই যথেষ্ট।

৫. কোরবানির দিন: ১০ জিলহজ। কোরবানির দিন। বছরের সর্বোৎকৃষ্ট দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত দিন হচ্ছে কোরবানির দিন। আবু দাউদ ও নাসায়ি

ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন কোনো দিন নেই যে দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহর কাছে জিলহজের এই ১০দিনের অপেক্ষা অধিক প্রিয়। সাহাবারা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি এতো প্রিয় নয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এর চাইতে অধিক প্রিয় নয়। তবে কোনো ব্যক্তি যদি নিজের সত্ত্বা ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে বেরিয়ে যায় এবং এ দু’টির কিছু নিয়ে আর ফিরে আসতে না পারে তবে তার ব্যাপার ভিন্ন। অর্থাৎ শহিদের মর্যাদা স্বতন্ত্র। তিরমিজি।

১. হজ-ওমরা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা পরপর হজ ও ওমরা করো। কেননা, হজ ও ওমরা দারিদ্র ও গুনাহ দূর করে দেয়, যেমন হাপরের আগুনে লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর হয়। কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। তিরমিজি হাদীস: ৭৫৭।

২. নফল রোজা ও নামাজ: জিলহজের ১০দিনে নফল রোজা রাখার অনেক সওয়াব। আল্লাহ তা খুবই পছন্দ করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজের ১০ দিনের ইবাদতের চাইতে অধিক প্রিয়। প্রতিটি রোজা একবছরের রোজার সমতুল্য এবং এর প্রতিটি রাতের শবেকদরের ইবাদতের সমতুল্য। তিরমিজি : ৭০৬।

তবে আরাফার দিনের রোজার ফজিলত স্বতন্ত্র, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে তিনি আরাফাতের দিনের রোজার বিনিময়ে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। (তিরমিজি: ৬৯৭)

৩. জিকির: কল্যাণের এ দশকে অধিক হারে আল্লাহর জিকির ও তসবি পাঠের জন্য হাদিস শরিফে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জিলহজের ১০দিনের চাইতে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান দিন নেই। আর এমন কোনো দিন নেই যে দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে এ ১০দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। অতএব, তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পড়ো। (আহমদ)

৫. কোরবানি: সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এছাড়া নফল কোরবানিও করা যায়। কোরবানি প্রভুপ্রেমের নিদর্শন ও তার পানে নিবেদন। এর বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে অশেষ সওয়াব ও বিপুল ক্ষমার আশ্বাস। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমাকে (রা.) উদ্দেশ্য করে বলেন, হে ফাতেমা! তুমি তোমার কোরবানির কাছে যাও এবং তা দেখো। কেননা, কোরবানির পশুর রক্তের প্রথম ফোটার বিনিময়ে তোমার অতীত সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বাজ্জার, আততারগিব ওয়াততারহিব : ৬২৪)

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, (কোরবানির পশুর) প্রত্যেকটা চুলের বিনিময়ে একটা সওয়াব। প্রত্যেকটা পশমের জন্য একটা সওয়াব। (হাকেম, আততারগিব ওয়াততারহিব : ৬২৩)

এছাড়া পূণ্যময় এ দশকে প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর সন্তোষ ও করুণা অর্জনের উদ্দেশে যার যার সাধ্য মোতাবেক সৎ কাজ বাড়িয়ে দেওয়া যায়। যেমন, দান-সদকা, কোরান তেলাওয়াত, কোরান শিক্ষা, ইসলামি জ্ঞান ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, দুঃস্থ ও অসহায় লোকদের সেবায় আত্মনিয়োগ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ, দাওয়াত ও জনকল্যাণমূলক তৎপরতার মাধ্যমে কল্যাণময় এ দশক উদ্যাপন করারও সুযোগ রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন। (আমিন)

লেখক: লেখক: ইমাম, খতীব ও গবেষক, কাতার

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।