আনন্দঘন পরিবেশে শিশুর শিক্ষা লাভ একটি জন্মগত অধিকার। ভয়ভীতি আর নৃশংসতা দিয়ে আর যাই হোক অন্তত শিক্ষাদান করা যায় না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নির্দেশও জারি করেছে। কিন্তু এরপরও থেমে নেই শিক্ষার্থী প্রহার। স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি না থাকায় শুধু প্রহার নয় নৃশংসতার মতো ঘটনাও ঘটছে। প্রতিনিয়তই খবরের কাগজে দেশের কোনো না কোনো এলাকায় শিক্ষার্থী প্রহারের খবর আসছে। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ‘কল্পিত’ চুরির অভিযোগে দিনাজপুরের একটি মাদ্রাসায় এক শিশুর শিক্ষার্থীর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণে আমরা মনে করি, চুরির অভিযোগে একজন শিশু শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে প্রহার করে ওই শিক্ষকরা আসলে শিক্ষকদের মর্যাকে অবমাননা করেছেন, কলংকিত করেছেন শিক্ষক সমাজকে। আমরা জানি, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের যে মর্যাদা- তা অর্থ মূল্য বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তার পরও আজ গুটিকয়েক অবিবেচক পাষণ্ডশিক্ষকের কারণে মহান শিক্ষকদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর শৈশব-কৈশর হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তিকাল। স্বচ্ছ মেধা, সুস্থ বুদ্ধি, সরল চিন্তা ও স্পষ্ট মনোযোগের কারণে শিশুরা সহজেই সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে। সঙ্গত কারণেই তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিও অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম হতে হয়।
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে শিশুরা সব ধরনের দায়ভার ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত। তারা শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল তেমনি মানসিকভাবেও কোমল। তাই তাদের সঙ্গে কোমল ও নরম আচরণ করতে হয়। তাদেরকে শিক্ষাদান করতে হয় স্নেহ-মমতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ধমক, কঠোরতা ও প্রহার পরিহার করে নম্রতা ও কোমলতার পথ অবলম্বন করতে হয়। যে নম্রতা ও কোমলতার আচরণ করতেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হজরত রাসূলে কারিম (সা.)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসের শেষে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা আমাকে হঠকারী ও কঠোরতাকারীরূপে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ-কোমল আচরণকারী শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন। -সহিহ মুসলিম এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, এ হাদিস থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুল-ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সঙ্গে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক ও ভৎর্সনা দিয়ে নয়, প্রহার করে রক্তাক্ত করে নয়।
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম স্কলার ইমাম মুহিউদ্দীন নববী (রহ.) শিক্ষকের করণীয় সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, শিক্ষকের উচিত তার ছাত্রের সঙ্গে নরম ব্যবহার করা, তার প্রতি সদয় হওয়া। তার কোনো ভুল হলে বা অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ পেলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। বিশেষত শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে।
রাগান্বিত অবস্থায় শিশুদের প্রহার করা মারাত্মক অন্যায়। স্বভাব-প্রকৃতির কারণে শিশুরা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম হয়। তাই শিশুদের শিক্ষাদান খুব কঠিন কাজ। শান্ত-শিষ্টতার চেয়ে চপলতা ও চঞ্চলতাই তাদের মধ্যে প্রবল। ফলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টকর। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, শিক্ষকের মধ্যে ক্রোধের ভাব সৃষ্টি হয় এবং প্রহার করার মতো পরিস্থিতি সামনে আসে। এ অবস্থায়ও শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। এটাই ইসলামের শ্বাশ্বত শিক্ষা ও ধর্মীয় নির্দেশনা।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান করো, সহজ ও কোমল আচরণ করো; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)। -মুসনাদে আহমদ শিশুদেরকে বা অন্য কাউকে প্রহার করা সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তার থেকে এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে। -আল আদাবুল মুফরাদ হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, কখনো রাগান্বিত অবস্থায় কোনো শিশুকে প্রহার করবে না। পিতা ও উস্তাদ উভয়ের জন্যই এ কথা।
উল্লেখিত ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বাণী ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি বাদ দিলেও শিশুদের প্রহারের অশুভ প্রতিক্রিয়া হয় বহুমুখী। প্রথমত যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তার শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে আসছে মারধরের দু’একটি ঘটনায় তার সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়।
দ্বিতীয়ত মারধরের ঘটনায় দ্বীন শিক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। মানুষ ভাবতে থাকে যে, মাদ্রাসা মানেই শাস্তির জায়গা, মারধরের স্থান; অনেকটা জেলখানার মতো। ফলে অনেক দ্বীনদার মুসলিম পরিবারের সন্তানরা মাদ্রাসায় যেতে চায় না।
তৃতীয়ত মারধরের ঘটনায় মাদ্রাসার শিক্ষকদের ব্যাপারে এ দুর্নাম ব্যাপকভাবে রটে যায় যে, তারা সবাই ছাত্রদের পিটায়। তাদের কোনো দয়ামায়া নেই; এরা অসামাজিক চরিত্রের লোক। এভাবেই গুটিকয়েক অর্বাচিন শিক্ষকের অজ্ঞতামূলক আচরণের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজকে দুর্নাম বহন করতে হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যেখানে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম এমন মনোভাব পোষণ করেছে, সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার সময় এমন কঠোরতা ও মারধর যে ইসলাম বহির্ভূত কাজ তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং শিশু শিক্ষায় কোনো অবস্থাতেই মারধর কার যাবে না। হ্যাঁ, কোনো ছাত্র যদি মাত্রাতিরিক্ত অন্যায় করে ফেলে তাহলে তাকে অভিভাবকের কাছে সোপর্দ করে দিবে। প্রয়োজনে মাদ্রাসা থেকে তাকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মারধরের মতো ঘটনা ঘটাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘন্টা, মে ২১, ২০১৫
এমএ/