আল্লাহতায়ালা তার রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। -সূরা আল আম্বিয়া: ১০৭
বাস্তবিকই যখন বিশ্বমানবতা মহাকালের মহাদুর্যোগে নিপতিত, যখন পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক বৈষম্য ও সংঘাত, অর্থনৈতিক বঞ্চনা আর রাজনৈতিক শোষণের শিকারে পরিণত হয়ে মুক্তির সন্ধানে উপায়ান্ত হারিয়ে মানবতা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, তখন তার মুক্তির জন্য মহান বিধাতার বিশেষ করুণাই ছিল একমাত্র উপায়।
হজরত রাসূলে কারিম (সা.)-এর জন্মের পর থেকে দীর্ঘ চল্লিশটি বছর নিজের মেধা আর উদ্ভাবনি শক্তি দিয়ে সমাজের আদলকে বদলের চেষ্টা করে চলেছিলেন। পরে চল্লিশ বছর বয়প্রাপ্তির পর নবুওয়ত লাভ করে মহান আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী কুড়ি বছরের বিরামহীন চেষ্টায় মানব সমাজে বিরাজিত সকল পঙ্কিলতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তির ঠিকানায় উপনীত হতে পেরেছিলেন। বাকি ছিল শুধু চুড়ান্ত ঘোষণাটা। যে ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন হিজরি দশম বর্ষে বিদায় হজের সমাবেশে।
আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের জীবন, সম্পদ আর ইজ্জতের নিরাপত্তায় আল্লাহর রাসূলের ঘোষণা, রাসূলুল্লাহ (সা.) হামদ ও সালাতের পর সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন, হে মানব সকল! আজকের দিন, এই মাস আর এই সমাবেশের স্থান তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র; তেমনি তোমাদের জীবন, সম্পদ আর ইজ্জত পরস্পরের নিকট পবিত্র ও সুরক্ষিত। এগুলোর ক্ষতিসাধনকে আল্লাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
সামজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় আরব সমাজে যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা প্রতিশোধ প্রথা উচ্ছেদ জরুরি ছিল। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, হে মানব সকল! হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ জাহেলি যুগের প্রথা, আজ তা সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করা হলো। আমি সর্বপ্রথম কোরাইশ বংশের রাবিয়া ইবনে হারেসের পুত্রের খুনের দায় রহিত ঘোষণা করছি।
সুদ সকল প্রকার সামাজিক বৈষম্যের উৎস। ইসলামের সাম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জাকাতকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দিতে সুদব্যবস্থা উচ্ছেদের বিকল্প নাই। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, জাহেলি যুগের সুদপ্রথা চিরদিনের জন্য বাতিল করা হলো। এখন থেকে তোমরা শুধু তোমদের পাওনার আসলটা ফেরত পাবে। আর এই ঘোষণা এই মুহূর্ত থেকে কার্যকর করার জন্য আমি (আমার চাচা) আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পাওনা সুদ-আসল সম্পূর্ণটাই বাতিল করে দিলাম।
শ্রেণী, গোত্র ও বর্ণের ভিত্তিতে চলে আসা কৌলিন্য মানব সমাজকে বহুধা বিভক্ত করে রেখেছিল। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, হে মানব সকল! তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতাও এক। সুতরাং অনারবের প্রতি আরবের কোনো বৈষম্য করা চলবে না। তেমনি আরবের ওপর অনারবেরও কোনো বৈশিষ্ট্য বিবেচিত হবে না। কালোর ওপর সাদার আর সাদার ওপর কালোর তাকওয়া ভিন্ন- অন্য কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই বেশি মর্যাদবান, যে বেশি মুত্তাকি।
নারী ছিল তৎকালীন সমাজে পুরুষের ভোগের সামগ্রী। জীবন, সভ্যতা ও সমাজের সূতিকাগার নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন ছিল সব থেকে বড় বিষয়। বিদায় হজের দিন মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, পুরুষ নারীর ওপর দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং তোমরা নারীদের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় করবে। জেনে রেখো, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে। তেমনি তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের অধিকার আছে। তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ আল্লাহর আমানত হিসেবে, আর আল্লাহর বিধামমতে তোমরা তাদেরকে হালাল করে নিয়েছ।
অতীত থেকে চলে আসা দাসপ্রথা ছিল মানব সমাজের জন্য সব থেকে ঘৃণ্য প্রথা। মানুষ মানুষের মালিক, এ এক বিরাট অভিশাপ! হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ দাসপ্রথা বিলুপ্তির পথই রচনা করে। তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, সাবধান! দাস-দাসীদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থাকবে। মনে রাখবে, তোমাদের যেমন একটি হৃদয় আছে তেমনি তাদেরও একটি হৃদয় আছে। তারা বেদনায় আহত হয়, আনন্দে আপ্লুত হয়। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খেতে দেবে, তোমরা যেমন কাপড় পরবে তাদেরকেও তেমনি কাপড় পরতে দেবে। যদি কোনো নাক-কান কাটা হাবশি গোলমকেও তোমাদের ওপর কোনো দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ করা হয়, তাহলেও তোমরা তার আদেশ-নিষেধ মান্য করবে। -সহিহ বোখারি
মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ বৈশ্বিক সম্মেলনে রাসূলে কারিম (সা.)-এর ভাষণ মানব মুক্তির মহাসনদ হিসেবে আজও সারাবিশ্বে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রতি বছর মহান আল্লাহর নির্দেশে পালিত ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিধান হজ এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমিরে হজের খুতবা চলমান পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পথ নির্দেশ করে।
লেখক: ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
এমএ/