পোল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশের মধ্যস্থলের একটি রাষ্ট্র। রাজধানীর নাম ওয়ার্শ।
পোল্যান্ড একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পোল্যান্ডের পোজনান শহরে পোলিশ মুসলমানরা সম্প্রতি (২৯ নভেম্বর) প্রথমবারের মতো সন্ত্রাসবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ করেছে।
পুরোদস্তুর খ্রিস্টান ক্যাথলিক দেশ পোল্যান্ডে মুসলমান নেতাদের আহবানে এ রকম সমাবেশ এটাই প্রথম।
প্রায় তিনশ’ মুসলমান দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় পোজনান শহরে মিলিত হয়ে ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসবিরোধী’ এবং ‘বর্ণবাদ বন্ধ কর’ প্ল্যাকার্ড হাতে সমাবেশ করে।
তিন কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার দেশ পোল্যান্ডে প্রায় ৯০ শতাংশ নাগরিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সরকারি হিসাবে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। এখানে তারা তাদের ধর্ম কর্ম পালন করছেন অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে৷
সন্ত্রাসবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশের আহ্বায়ক পোজনান মসজিদের ইমাম ইউসুফ চাদিদ বলেন, আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরোধী এবং ফ্রান্সসহ সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী হামলার শিকার নিরপরাধ মানুষদের প্রতি সমব্যথী।
আর পোল্যান্ডের মুসলিম নাগরিক সমিতির প্রধান টমাস মিসকোভিচ বলেন, কিছু পোলিশ লোক চরম বর্ণবাদী এবং তারা মনে করে, সব মুসলমানই সন্ত্রাসী। তাই পোল্যান্ডের মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এখানে সমাবেশ হয়েছে।
ইতোমধ্যেই পোল্যান্ডের মুসলমানদের শান্তি সমাবেশ সাড়া ফেলেছে ইউরোপে। এমন সমাবেশ বিভিন্ন স্থানে আয়োজনের প্রস্তুতিও চলছে।
পোল্যান্ডের মতো খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে মুসলমানরা কীভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের ধর্ম বজায় রাখতে পারছেন- সেটা একটি আশ্চর্যই বটে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ডেই সবচেয়ে কম সংখ্যক মুসলমান বাস। তা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্ম কর্ম পালনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না সেখানে৷ এমনকি ১০ বছর ধরে পোলিশ ক্যাথলিক গির্জার ক্যালেন্ডারে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ‘ইসলাম দিবস’ হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে৷
পোল্যান্ডের একেবারে পূর্বে বিয়ালিস্টক নামের শহরে অসংখ্য উঁচু দালানের মধ্যে ছোট একটি বেগুনি রং-এর কাঠের বাড়ি চোখে পড়ে৷ সেখানে পোলিশ মুসলমানরা নামাজের জন্য মিলিত হন৷ এটাই তাদের ইবাদতের জায়গা। যেটাকে মসজিদ বলা হয়।
মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.১ শতাংশ সেখানে মুসলমান৷ অধিকাংশই বিয়ালিস্টক শহরের আশেপাশে বসবাস করেন৷ তাদের একজন ৭০ বছর বয়সী হালিমা সাচিডেভিচ৷ মুসলিম সংগঠনের প্রধান তিনি। হালিমা জানান, ‘বলা যায় আমরা এখানে ক্যাথলিকদের এক সাগরে বাস করছি৷ কিন্তু তবু আমরা ভালো আছি এখানে৷ অন্যান্য ধর্মের জন্য পোল্যান্ড খোলামেলা এক দেশ৷ তা নাহলে সম্ভবত আমাদের এই দেশে এত দীর্ঘ দিনের ইতিহাস থাকতো না৷’
৬০০ বছর আগে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তাতার জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এশিয়া বিশেষ করে তুরস্ক থেকে পোল্যান্ডে এসেছিলেন৷ তুরস্কের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পোল্যান্ডের রাজা ইওহানেস সবিস্কিকে সাহায্য করেছিলেন যুদ্ধে পারদর্শী তাতাররা৷ আর তাদের এই বীরত্বের জন্য রাজার কাছ থেকে এক খন্ড জমি উপহার পেয়েছিলেন তারা৷ সেই থেকে তারা সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতাররা পোল্যান্ডের সমাজে মিশে যান৷ জানান, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামতত্ববিদ আগাটা নালবোরচিক ৷
‘তারা তাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন৷ তারা এখন পোলিশ ভাষায় কথা বলেন৷ কিন্তু নিজেদের ধর্ম তারা হারাননি৷ এতে বোঝা যায় পোল্যান্ডের খ্রিস্টানরা বেশ সহনশীল৷ এছাড়া পোল্যান্ডের রাজাও তাদের দেখভালের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন৷’
তখন থেকে মুসলিম তাতাররা প্রতিবেশী ক্যাথলিকদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছেন৷ ১৯৩৬ সালে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং স্কুলে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ ছাত্ররা এমনকি আরবি ভাষা শেখারও সুযোগ পায়৷
১২ বছর আগে ক্যাথলিক ও মুসলমানরা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের লক্ষ্যে যৌথ এক পরিষদ গড়ে তোলেন৷ পোল্যান্ডের গির্জার বিশপ ও সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা এই পরিষদকে সহযোগিতা করছেন৷ ইউরোপে এরকম আর দ্বিতীয়টি নেই৷ বলেন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আগাটা নালবোরচিক৷ তিনি ব্যাখ্যা করে জানান, ‘আমাদের লক্ষ্য খ্রিস্টানদের ইসলাম ও মুসলমানদের খ্রিস্ট ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে আসা৷ প্রথমে আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে৷ ইসলাম সম্পর্কে এখন অনেক কিছু বলা হচ্ছে৷ সব মুসলিমই যে সন্ত্রাসী ও কট্টরপন্থি নয়, সেটা সুস্পষ্ট করতে হবে৷’
দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সংলাপ জোরদার করতে পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজিত হচ্ছে সম্মেলন ও আলোচনা অনুষ্ঠান৷ প্রকাশিত হচ্ছে বই পুস্তক৷ এমনকি ক্যাথলিক ও মুসলিমদের এক সাথে প্রার্থনারও আয়োজন করা হচ্ছে৷ প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে রয়েছেন ক্যাথলিক ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরা৷ যাতে দুই ধর্মেরই সমমর্যাদা প্রকাশ পায়৷
মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করছেন আর্টুর কনোপাকি৷ তিনি বলেন, ‘আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের ধর্মের নানা দিক দিক তুলে ধরি৷ বাস্তবে খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে৷ আর মিলগুলোই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, পার্থক্য নয়। আমার সংঘাত চাই না। শান্তি চাই। এটাই ইসলাম ধর্মে বৈশিষ্ট্য। আর মুসলমান হিসেবে এটা আমাদের মানতে হবে। ’
আপাতত মিলেমিশে থাকার পদ্ধতিই যে পোল্যান্ডের মুসলমানদের শান্তিতে থাকার অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগাচ্ছে- সেটা অনেকটাই নিশ্চিত।
ইসলামি স্কলারদেরও অভিমত অনেকটা এমনই। তাদের কথা হলো, ধর্মের মর্মবাণী শান্তি। কিন্তু ধর্ম প্রচারে যেয়ে যদি আপনার থেকে অশান্তিই প্রকাশ পায়, তাহলে আপনাকে কী ধর্ম প্রচারক বলা যাবে, কিংবা ধর্মানুরাগী? বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় বোধহয় এখনই!
-অন ইসলাম অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৫
এমএ/