হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। পিতা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব।
নবী করিম (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করার পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কোরাইশরা যখন বনি হাসেম গোত্রকে বয়কট করেছিল, তখন তার জন্ম হয়। দশ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। শৈশবে একবার খালা হজরত মাইমুনার (রা.) ঘরে গিয়ে নবী করিমের (সা.) অজুর পানি এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তখন নবী করিম (সা.) খুশি হয়ে তার জন্যে দোয়া করেন। ওই দোয়ায় নবী করিম (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করো এবং কোরআনে কারিমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জ্ঞান দাও। ’
বলা হয়, এই দোয়ার বরকতে তিনি বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হন। অগাধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে তিনি পরবর্তীতে ‘তরজুমানুল কোরআন’ (কোরআনের মুখপাত্র) এবং ‘হিবরুল উম্মাহ’ (উম্মতের মহাজ্ঞানী) উপাধিতে ভূষিত হন ।
হজরত নবী করিম (সা.) তাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। একবার নবী করিম (সা.) ইবনে আব্বাসকে (রা.) উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে বৎস! আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধ রক্ষা করো, তাহলে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন। তাকে মেনে চলো, তাহলে সর্বদাই তুমি তাকে নিজের সঙ্গে অনুভব করবে। যদি কারো কাছে কিছু চাইতে হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে চাও। যদি সাহায্য প্রার্থনার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তার কাছেই প্রার্থনা করো। ’
মনে রেখ, ‘আল্লাহতায়ালা তোমার ভাগ্যে যে কল্যাণ লিখে রেখেছেন, সব মানুষ মিলে চেষ্টা করলেও তোমাকে এর চেয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি কল্যাণ পৌঁছাতে সক্ষম হবে না। আর যদি সবাই মিলে তোমার অনিষ্ট সাধনে সচেষ্ট হয়, আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার বাইরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অনিষ্ট সাধনে কেউ সক্ষম হবে না। ’
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দ্বীনী জ্ঞানে তার গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.) জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং ক্ষেত্রবিশেষ তার পরামর্শ মতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি ‘বাহরুল ইলম’ (বিদ্যাসাগর) উপাধিতে ভূষিত হন।
বিজ্ঞ সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) তার গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি ইবনে আব্বাসের চেয়ে উৎপন্নমতি, প্রাজ্ঞ ও ধৈর্যশীল আর কাউকে দেখিনি। ’
আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাকে দেখলে বলতেন, ‘বিচক্ষণ, অনুসন্ধিৎসু ও বিবেকবান যুবকের আগমন ঘটেছে। ’
একবার রোমের বাদশা হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) কাছে প্রশ্ন করে পাঠালো যে, কোন কবর তাতে সমাহিত ব্যক্তিকে নিয়ে ভ্রমণ করেছিল? হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নিজ বিচক্ষণতায় বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রশ্নকারী এখানে কবরের রূপক অর্থ গ্রহণ করেছেন। তিনি ওই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, হজরত ইউনুস (আ.)-এর কবর তাকে নিয়ে ভ্রমণ করেছে। অর্থাৎ যে মাছটি তাকে গিলে ফেলেছিল সেটি তাকে নিয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত সমুদ্র গর্ভে ছুটোছুটি করেছিল।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) প্রতিদিন ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। একদিন মাসআলা শিক্ষা দিতেন, অন্যদিন শিখাতেন কোরআন শরিফের তাফসির। তার কথায় মানুষ বিমোহিত হতো। কেউ তার কাছে কোনো কথা বলতে আসলে তিনি তা আগ্রহভরে শুনতেন। দু’টি বিষয়ের মধ্যে একটিকে গ্রহণ করতে বললে তিনি অপেক্ষাকৃত সহজটি বেছে নিতেন ।
তিনি বলতেন, মানুষ যখন সর্বপ্রথম স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করল, ইবলিস তা নিয়ে নিজ কপালে রেখে বলল, আমি অবশেষে মানুষকে ধর্মবিমূখ ও পথভ্রষ্ট করে জাহান্নামে নেওয়ার অস্ত্রটি পেয়ে গেলাম। একটি মুসলিম পরিবারের এক মাস বা এক সপ্তাহের খরচ বহন করা, বার বার হজ করার চেয়েও আমার নিকট প্রিয় । যে ব্যক্তি কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করবে, সে বাধ্যর্ক্যের জ্বরাগ্রস্থ হবে না ।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের সময় তার বয়স ছিল দশ বছরের কিছু বেশি। তার পরও তিনি জ্ঞানের গভীরতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ নবী করিমের (সা.) জীবদ্দশায় তিনি কখনও তার মজলিস ছেড়ে যেতেন না। তার ইন্তেকালের পর তিনি সাহাবাদের থেকে জ্ঞান লাভের জন্য সদা উদগ্রীব থাকতেন। তিনি বলেন, কখনও আমি একটি বিষয় সস্পর্কে ত্রিশ জন সাহাবাকে প্রশ্ন করেছি।
বস্তুত প্রিয় নবীর (সা.) দোয়া ও নিজ আগ্রহ তাকে জ্ঞানের এ গভীরতায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
তিনি ৬৮ হিজরি সনে ৮১ বছর বয়সে তায়েফ নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
-আবনাউস সাহাবা অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
এমএ