ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

সর্বদা হাসিমুখে কথা বলতেন প্রিয় নবী সা.

আতাউর রহমান খসরু, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৬
সর্বদা হাসিমুখে কথা বলতেন প্রিয় নবী সা.

কথাবার্তা ও আলাপচারিতায় মানুষের ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে ওঠে। স্পষ্ট হয় তার শিক্ষা ও শিষ্টাচার, রুচি ও ব্যক্তিবোধ, মন ও মানসিকতা।

সঠিক শব্দচয়ন, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, মিষ্টি ভঙ্গি ও বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা একজন মানুষকে অনন্য গ্রহণযোগ্যতা দেয় সবার মাঝে। আবার অসংযত ও অযাচিত কথাবার্তা জীবনে বয়ে আনে দুর্যোগ। তাই ইসলামের নির্দেশনা হলো- মানুষ তার কথায় সংযত হবে, উত্তম ভাষায় মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলবে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবন ও আদর্শের মাধ্যমে আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।

কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে রাসূল (সা.) প্রথমে সালাম প্রদান করতেন। অতপর তিনি কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আগে সালাম পরে কথা। ’ -সুনানে তিরমিজি : ২৮৪২

নবী করিম (সা.) ছোট-বড় সবাইকে সালাম প্রদান করতেন এবং প্রথমে সালাম দিতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে পথ চলছিলেন। তখন রাসূল (সা.) কয়েকটি শিশুকে অতিক্রম  করছিলেন। তিনি তাদেরকে সালাম করলেন। ’ সহিহ মুসলিম : ৫৭৯৩
 
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি কখনও মুখ কালো করে থাকতেন না। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-ব্যথাগুলো তার কথা ও আচরণে প্রকাশ পেতো না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) অপেক্ষা অধিক মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখি নি। ’ -মুসনাদে আহমদ : ১৭৭৪০

হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে রাসূল (সা.) আমাকে তার দরবারে উপস্থিত হতে বাঁধা দিতেন না এবং আমাকে দেখলেই তিনি মুচকি হাসতেন। ’ -সহিহ বোখারি : ৩৮২২

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা হাসিমুখে থাকতেন এবং মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। তার শব্দ ও বাক্য, উচ্চারণ ও ভঙ্গিমা সবকিছুই ছিলো- বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ; বরং বলা যায় সাহিত্যের উত্তম নিদর্শন। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, ‘রাসূল (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষী। ’ -কানজুল উম্মাল : ৩৫৪৭১

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কথা বলার সময় যেমন তাড়াহুড়া করতেন না, তেমনি এতো ধীরে বলতেন না যাতে কথার ছন্দপতন হয়। বরং প্রতিটি কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাদের মতো এক নাগারে তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না; বরং তিনি প্রতিটি কথা পৃথক পৃথক স্পষ্ট ভাষায় বলতেন। যাতে তার পাশে উপবিষ্ট ব্যক্তিরা তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। ’ -সুনানে তিরমিজি : ৩৬৩৯

রাসূলে আকরাম (সা.) যখন কোনো মজলিসে কথা বলতেন, তখন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) তার কথাকে তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন, যেনো তা ভালোভাবে বোঝা যায়। ’ -শামায়েলে তিরমিজি : ২২২

এবং তিনি মজলিসের কোলাহল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। দাঁড়িয়েই কথা বলা শুরু করতেন না। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় বিদায় হজের সময় রাসূল (সা.) তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বল। অতপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না ....। ’ -সহিহ বোখারি : ৭০৮০‍ৎ

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পারস্পারিক আলোচনার সময় অন্যের কথা মনোযোগসহ শুনতেন। অপরজন চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি তার দিক থেকে চেহারা ফেরাতেন না। আর কেউ তাকে কানে কানে কিছু বলতে চাইলে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাথা সড়াতেন না। পারস্পারিক আলাপচারিতার সময় কারো মুখ থেকে কোনো অসঙ্গত কথা বেরিয়ে গেলে তিনি সরাসরি তার নাম উল্লেখ করে লজ্জা দিতেন না; বরং তাকে এভাবে সতর্ক করতেন যে, মানুষের কী হলো যে তারা এমন কথা বলে বা এমন কাজ করে। -মাওলানা নোমান আহমদ রহ., আমাদের নবীজীর (সা.) দৈনন্দিন জীবন, পৃষ্ঠা-৫৯

হজরত রাসূলে আকরাম (সা.) কথাবার্তায় কখনও কখনও রসিকতা করতেন। তবে সত্য কৌতুক করতেন। কখনও মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘সাহাবাগণ বললো, হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আপনি আমাদের সঙ্গে হাসি-কৌতুক করেন। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি শুধু সত্যই বলি (কৌতুক করি)। ’- শামায়েলে তিরমিজি : ১৯৪

রাসূল (সা.) এমন কোনো রসিকতা করতেন না যাতে মানুষের সম্মান নষ্ট হয় বা মনে কষ্ট পায়; বরং তিনি রসিকতার জন্য সত্য উপাদান বেছে নিতেন। যেমন হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী সা. তাকে কৌতুক করে দুই কানওয়ালা ডেকে ছিলেন। ’ -সুনানে আবু দাউদ : ৫০০৪

হজরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর কথাবার্তা, আলোচনা ও আলাপচারিতা সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে। যেখানে রাসূল (সা.)-এর বাচনভঙ্গি ও কথা বলার রীতিগুলো একসঙ্গে ও অধিক স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাহলো-

হজরত হাসান (রা.) বলেন, আমি আমার মামা হিন্দ ইবনে আবু হালা-যিনি রাসূল (সা.)-এর গুণাবলী বর্ণনা করতেন। তাকে বললাম, আমাকে রাসূল (সা.)-এর কথা বলার রীতি ও ধারা সম্পর্কে বলুন! তিনি বললেন, রাসূল (সা.) পরকালের চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। উম্মতের চিন্তা তাকে বিভোর করে রাখতো। এসব চিন্তার কারণে তিনি কখনও স্বস্তি পেতেন না। অধিকাংশ সময় চুপ থাকতেন। প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতেন না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। গুছিয়ে কথা বলতেন। একটি বাক্য থেকে অন্য বাক্য পৃথক থাকতো। কথায় বাহুল্য থাকতো না এবং অতি সংক্ষিপ্তও হতো না। তার কথায় কঠোরতা থাকতো না এবং কাউকে হেয় করতেন না। আল্লাহর নেয়ামতসমূহকে বড় করে উপস্থাপন করতেন। যদিও তা ছোট হতো। তার নেয়ামতসমূহের কোনো সমালোচনা করতেন না। তবে আহারসামগ্রি হলে তার নিন্দাও করতেন না এবং প্রসংশাও করতেন না।

জাগতিক কোনো বিষয় (এর ক্ষতি) তাকে ক্রোধান্বিত করতো না। তিনি এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কিন্তু কেউ অন্যায় কাজে সীমালঙ্ঘন করলে তার ক্রোধের সীমা থাকতো না; যতোক্ষণ না তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন। তিনি নিজের জন্য কখনও রাগ করতেন না এবং প্রতিশোধও নিতেন না। তিনি কোনো বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করলে পুরো হাতের তালু দিয়ে ইঙ্গিত করতেন। আর বিস্মিত হলে হাত ঘোরাতেন। যখন আলোচনা করতেন, হাতের সঙ্গে হাত মেলাতেন। ডান হাতের তালু বাম হাতের আঙুলের অন্তরভাগে মারতেন। কারও ওপর রাগ করলে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং অমনোযোগী থাকতেন। আর খুশি হলে চোখ অবনত হয়ে যেতো। তার অধিকাংশ হাসিই ছিলো স্মিত। হাসলে তার পবিত্র দাঁতসমূহ বরফের মতো উজ্জ্বল দেখাতো। ’ -শামায়েলে তিরমিজি : ২২৩

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০3, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।