ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ ছবি: সংগৃহীত

তীব্র তাপদাহ সর্বত্র। ফলে আইসক্রিম ও ফ্রিজারের ঠাণ্ডা পানীয়ের চাহিদা বেড়েছে।

শহরাঞ্চলে রাস্তার শরবতের কদর বেড়েছে ব্যাপক। অস্বাস্থ্যকর জেনেও অনেকেই এসব শরবত পান করে প্রাণ জুড়াচ্ছেন। তাপদাহে দেশ পুড়লেও বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশে কিছু মেঘের দেখা মিললেও তা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে না। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আরো কমপক্ষে দুই থেকে ৩ দিন তাপদাহের অবস্থা থাকবে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হতে পারে।

দুনিয়ায় আল্লাহতায়ালার অজস্র কুদরত ও নিদর্শনের মধ্যে বৃষ্টি এক বিশেষ নিদর্শন। বৃষ্টি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, প্রাকৃতিক সৌকর্য আনয়ন করে, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। বৃষ্টি আল্লাহতায়ালার খাস রহমতের নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) যিনি তার রহমতের (বৃষ্টির) প্রাক্কালে বাতাসকে সুসংবাদবাহকরূপে প্রেরণ করেন। যখন তা ঘন মেঘ বহন করে তখন আমি (আল্লাহ) তা নির্জীব ভূখণ্ডের দিকে চালনা করি, পরে সেটা হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি। তারপর তার দ্বারা সব ধরনের ফল-ফসল উৎপাদন করি। ’ -সূরা আরাফ: ৫৭

কোরআনে কারিমে বৃষ্টি সংক্রান্ত আরও অনেক আয়াত রয়েছে। যেগুলোর পাঠ ও গবেষণা করলে জ্ঞান রাজ্যের অনেক উপাদান পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বৃষ্টি বর্ষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ বিবরণও রয়েছে বেশ কিছু আয়াতে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর আমি আকাশ হতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি যা দ্বারা আমি মৃত ভূখণ্ডকে সজ্জীবিত করি এবং আমার সৃষ্টির মধ্যে বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করাই। -সূরা ফুরকান: ৪৮-৫০

বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা জীবনের পরতে পরতে বেশিরভাগ সময় অনুভূত হয়। মরুভূমির দেশেও বৃষ্টিপাত ঘটে। আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে বৃষ্টির নিজস্ব চেহারা রয়েছে। বৃষ্টিকে নিয়ে এখানে এত কাব্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে যে, তা ভাবনা জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

অতিবৃষ্টি কিম্বা অনাবৃষ্টি এ দুই অবস্থাতেই মানুষ নাজেহাল হয়ে পড়ে। অনাবৃষ্টি বা খরা প্রকৃতিতে বিষন্নতা এনে দেয়। এমনতরো অবস্থায় মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে বৃষ্টির জন্য দোয়া করা উচিত। সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহতায়ালার শরণাপন্ন হলে আল্লাহ বিপদ-আপদ, দুঃখকষ্ট, বালা-মুসিবত অবশ্যই দূর করে দেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘বরং তিনি (আল্লাহ), যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং আকাশ হতে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেন বৃষ্টি, অতঃপর আমি (আল্লাহ) তা দ্বারা মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি, ওগুলোর বৃক্ষাদি উদগত করবার ক্ষমতা তোমাদের (মানুষের) নেই। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? তবুও ওরা এমন এক সম্প্রদায় যারা সত্য বিচ্যুত হয়। বরং তিনি (আল্লাহ), যিনি পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং সেটার মাঝে মাঝে প্রবাহিত করেছেন নদী-নালা এবং তাতে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বত ও দুই দরিয়ার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অন্তরায়, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তবুও ওদের অনেকেই জানে না। বরং তিনি (আল্লাহ) যিনি আর্তের আহ্বানে (দোয়ায়) সাড়া দেন যখন সে তাকে (আল্লাহকে) ডাকে (দোয়া করে) এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করে দেন। -সূরা নমল : ৬০-৬২

অনাবৃষ্টি হলে আল্লাহর মহান দরবারে বৃষ্টির জন্য দোয়া করার নিয়ম রয়েছে। ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’- এ উচ্চারণ আমাদের দেশে খরার সময় উচ্চারিত হয়ে আসছে। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয় যে, আমাদের ঐতিহ্যে এটা রয়েছে।

ইসলামে বৃষ্টির জন্য দোয়া করার জন্য যে নামাজ আদায় করার নিয়ম রয়েছে সেই নামাজকে ‘ইসতিসকা’ বলা হয়।

ইসতিসকা শব্দের অর্থ বৃষ্টির জন্য দোয়া করা। হাদিস শরিফের বিভিন্ন গ্রন্থে ইসতিসকার নামাজ ও দোয়ার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীর মিম্বারে দাঁড়ানো অবস্থায় বৃষ্টির জন্য দোয়া করেছেন। আবার ঈদগাহে কিম্বা খোলা ময়দানে বিশাল সমাবেশে ইসতিসকার নামাজে ইমামতি করেছেন। বৃষ্টির জন্য দুই হাত তুলে মোনাজাতও করেছেন।

এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জুমার দিনে মিম্বরের সোজাসুজি দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। প্রিয়নবী (সা.) তখন মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি প্রিয় নবী (সা.)-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গবাদিপশু সব ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাগুলোতে চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সুতরাং আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন যেন তিনি বৃষ্টি দেন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার মোবারক হাত দু’খানা ওপরে তুলে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহুম্মাসকিনা আল্লাহুম্মাসকিনা আল্লাহুম্মাসকিনা; হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন, হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন, হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তখন আকাশে মেঘমালা দেখিনি, আকাশে মেঘের লেশমাত্রা নজরে পড়েনি। সালআ পর্বত ও আমাদের মাঝখানে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না। হঠাৎ সালআ পর্বতের পেছন থেকে ঢালের মতো মেঘ বেরিয়ে এল এবং মধ্যাকাশে গিয়ে বিস্তৃত হয়ে গেল। তারপর বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হলো। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা ছয়দিন সূর্যের দেখা পাইনি। পরবর্তী জুমার দিন সেই লোকটি দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। তখন প্রিয় নবী (সা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল, সড়কগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য দোয়া করুন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দুই মোবারক হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে বর্ষণ করুন, আমাদের ওপর আর বর্ষণ করবেন না- টিলা, পর্বত, উচ্চভূমি, মালভূমি উপত্যকা ও বনাঞ্চলে বর্ষণ করুন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, তৎক্ষণাৎ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল, আমরা রোদ মাথায় নিয়ে ফিরলাম। ’ –সহিহ বোখারি শরিফ

হাদিস শরিফে আছে, প্রিয় নবী (সা.) বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে বের হলেন। তিনি কেবলামুখি হয়ে দোয়া করলেন এবং নিজের চাদরখানা উল্টিয়ে দিলেন। তারপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তিনি উভয় রাকাতে কেরাত পাঠ করলেন সশব্দে। -সহিহ বোখারি শরিফ

অনাবৃষ্টি বা খরাজনিত কারণে বৃষ্টির জন্য আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করা সুন্নত। অনাবৃষ্টি আক্রান্ত এলাকার সর্বস্তরের মানুষ দীন-হীন পোশাক পরিধান করে খুবই বিনীতভাবে পায়ে হেঁটে খোলা ময়দানে সমবেত হয়ে বিনম্রভাবে কাতরস্বরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। তারপর ইমামের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজে আজান-ইকামত নেই। ইমাম কেরাত পাঠ করবেন উচ্চৈঃস্বরে। ইমাম তার গায়ের চাদর উল্টিয়ে নেবেন অর্থাৎ চাদরে ডান পার্শ্ব বামে এবং বাম পার্শ্ব ডানে পরিবর্তন করে কিবলামু‍খি অবস্থায় হাত উঠিয়ে দোয়া করবেন। এর আগে খুতবা দেবেন। বহু নজির আছে এই নামাজ শেষ হতে না হতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে। যদি না হয় মোট তিনদিন এই নামাজ আদায় করতে হয়।

নবী করিম (সা.) মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, মসজিদ থেকে ৩০৫ মিটার দূরে অবস্থিত ময়দানে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেছিলেন। বর্তমানে সেখানে ছাতার আকৃতির কয়েকটি গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ আছে। যার নাম ‘মসজিদে গামামা’ অর্থাৎ ‘মেঘের মসজিদ’।

ইসতিসকার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে নিয়ম এবং পদ্ধতিতে কিছুটা মতপার্থক্য বোঝালেও আল্লাহতায়ালার কাছে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করা খুবই কল্যাণকর ও বরকতময়। কারণ এ দোয়াটি স্বয়ং শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বৃষ্টির জন্য পাঠ করতেন। দোয়াটি হলো- 'আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। আর রাহমানির রাহিম। মালিকি ইয়াউমিদ্দিন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফ-য়ালু মা ইউরিদ। আল্লাহুম্মা আনতাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আনতাল গানিয়্যু ওয়া নাহলুল ফুকারাউ। আনজিল আলাইনাল গাইসা- ওয়াজয়া’ল মা আনজালতা আলাইনা কুওয়্যাতান ওয়া বালাগান ইলা হিন। ’

অর্থ: সব প্রশংসা পৃথিবীর প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তিনি পরম করুণাময় এবং দয়ালু ও শেষ বিচারের মালিক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই করেন। হে আল্লাহ! তুমিই একমাত্র মাবুদ, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তুমি ধনী, আমরা গরিব। আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করো এবং আমাদের জন্য যা অবতীর্ণ করো, তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও কল্যাণ দান করো।

এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার কাছে তার দয়া ও রহমত লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।