এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ অাদায় করেন আবদিল হান্নান খালাফ। তিনি মসজিদটিকে একটি মিলনস্থল বলে মনে করেন।
আমি আলজেরীয় বংশোদ্ভূত হলেও আমার মূল পরিচয় আমি মুসলমান। এখানে এসে অন্য মুসলমানদের সঙ্গে মিশে শিকড়ের বন্ধনটা অনুভব করি। বলতে পারেন, এই মসজিদ ফ্রান্সে ইসলামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজধানী প্যারিসের পঞ্চম অ্যারোঁদিসেমেন্ট এলাকায় (প্রশাসনিক এলাকা) সগর্বে মাথা উঁচু করে থাকা মসজিদের মিনারগুলো ঘোষণা করছে- ফরাসি মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতির কথা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করে নিহত কয়েক লাখ মুসলিম সৈন্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যুদ্ধের পর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
মসজিদ কমপ্লেক্সের বর্তমান প্রধান ডক্টর দলিল বুবাকের মসজিদের নির্মাণ ইতিহাস সম্পর্কে জানান, ১৮৩০ সালে আলজেরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার বিরাট একটি অংশ দখল করে ফ্রান্স। এর কারণে ওই অঞ্চলের প্রচুর লোক ফ্রান্সে আসে, কেউ স্বেচ্ছায়, কাউকে জোর করে আনা হয় শ্রমিক হিসেবে।
এরপর ওসমানি সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশ ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হলে ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে।
ডক্টর বুবাকের বলেন, অনেক মুসলিম উপনিবেশ থাকার কারণে ফ্রান্সকে তখনকার সময়ে একটি বড় মুসলিম শক্তি হিসেবে দেখা হতো। অসংখ্য মুসলমান প্যারিসে আসত। সে কারণেই তারা এখানে একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
তবে ওই সময় সেক্যুলার ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে একটি মসজিদ তৈরি করা সহজ ছিল না। ১৯০৫ সাল থেকে যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল ফ্রান্সে। এই আইনকে অগ্রাহ্য করে ১৯২১ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দ্য হাবাস সোসাইটি’ ও ‘হলি প্লেসেস অব ইসলাম’ যৌথভাবে মসজিদটি স্থাপন করে।
ডক্টর বুবাকের বলেন, ফ্রান্সের ইসলামের ইতিহাসে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। অনেক রাজনীতিবিদ ওই প্রকল্পকে সহযোগিতা করেন, সমাজও সেটিকে স্বাগত জানায়।
১৯৪০ সালে ফ্রান্স যখন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে সে সময় অনেক ইহুদির জীবন রক্ষা করে এই মসজিদটি। নাৎসিদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেক ইহুদি এই মসজিদে আশ্রয় নেয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের তৎকালীন প্রধান সিকান্দর বিন গাবরিত অনেক ইহুদিকে মুসলিম বলে পরিচয় দিয়ে জীবন বাঁচাতে ও পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত আলজেরিয়ান ইহুদি সঙ্গীতশিল্পী সেলিম হালালিও।
বৃহত্তর ফরাসি মুসলিম সমাজে একটি ‘আমব্রেলা অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করছে গ্রেট মস্ক। দেশটির সব ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও কয়েক শ’ মসজিদকে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছে এটি।
ডক্টর বুবাকের বলেন, ফ্রান্সে ইসলামের উপস্থিতিকে উজ্জীবিত রাখতে চেষ্টা করি আমরা। এখানকার মুসলমানদের বেশিরভাগই আলজেরিয়ান হলেও আমরা সব মুসলমানকে নিয়ে কাজ করি। আলজেরিয়াকে ১০০ বছরের বেশি শাসন করেছে ফ্রান্স, যার কারণে ৩০ লাখের বেশি আলজেরীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম আছে ফ্রান্সে।
প্যারিসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন অনেকে আসেন এখানে নামাজ পড়তে। কখনও কখনও লোকসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফ্রান্স সরকার ও সংখ্যাগুরু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমানদের সংযোগ রক্ষার কাজ করে মসজিদটি। জাতীয়পর্যায়ের অনেক রাজনীতিক এখানকার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসেন।
মসজিদ সংলগ্ন একটি ভবনে রয়েছে ব্যায়ামাগার। আছে একটি রেস্টুরেন্টও। যা সব ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এই রেস্টুরেন্টের আলজেরীয় বংশোদ্ভূত বাবুর্চির রান্নার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে প্যারিসজুড়ে।
ফ্রান্সে ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ফরাসি সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ৬০ লাখের মতো। পশ্চিম ইউরোপের যেকোনো দেশের তুলনায় ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ২, ২০০টি।
-মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
এমএইউ/