বর্তমান সময়ের ওয়াজ মাহফিলের আরেকটি বড় সমস্যা হলো- শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে মাহফিলের বক্তৃতার আওয়াজ অনেক দূর পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা। প্যান্ডেল থেকে অনেক দূরে অনেক উঁচুতে মাইক স্থাপন করা হয়।
ওয়াজ মাহফিল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনেকের ইচ্ছা থাকে ভালো। তারা চান, বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে যারা মাহফিলে উপস্থিত হতে পারেনি তারাও যেন ওয়াজ শোনা থেকে বঞ্চিত না হয়। মানছি, এটা অবশ্যই ভালো একটি পরিকল্পনা। কিন্তু কোনো ভালো কাজে যখন ক্ষতির দিকটিও নিশ্চিত থাকে, তখন ক্ষতির দিককে প্রাধান্য দিয়ে তা থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অনেকেই আবার ওয়াজের আওয়াজকে আজানের সঙ্গে তুলনা করেন। বলেন, উচ্চ আওয়াজে আজান দিতে সমস্যা না হলে মাহফিল করতে কেন সমস্যা হবে? আজানের সঙ্গে মাহফিলের তুলনা চলে না। কেননা, আজান একটি ঘোষণা। তা দেওয়া হয় অনুপস্থিতদের জন্য। তাই তা উচ্চ আওয়াজেই দিতে হবে। অনুপস্থিতদের কাছে আজানের আওয়াজ পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু মাহফিলে ওয়াজ করা হয় উপস্থিতদের জন্য। এ ছাড়া আজান হয় সামান্য সময়, মাইকে আজান শুরু হলে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মাহফিলের উচ্চ আওয়াজ চলতে থাকে একটানা সাত থেকে আট ঘণ্টা। এত দীর্ঘসময় শব্দযন্ত্রের আওয়াজের উচ্চমাত্রা এলাকার মানুষের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
অনেকেই আবার বলে থাকেন, যদি গানের কনসার্ট এভাবে হতে পারে তবে ওয়াজের মাহফিল কেন এভাবে হতে পারবে না। দেখুন, গানের কনসার্টের সঙ্গে ওয়াজ মাহফিলের তুলনা চলে না। কেননা, এক লোক বাম হাতে মদ পান করছে। সেক্ষেত্রে তাকে এ কথা বলা বড়ই হাস্যকর, ভাই! বাম হাতে মদ পান করবেন না। হাদিসে আছে, শয়তান বাম হাতে পানাহার করে। বরং তাকে বুঝাতে হবে, ভাই! মদ খারাপ জিনিস, মদ পান করা অবৈধ। তুমি মদ পান ছেড়ে দাও। পক্ষান্তরে কেউ যদি দুধ, শরবত বাম হাতে পান করে তখন তাকে বুঝাতে হবে, ভাই! বাম হাতে পান না করে ডান হাতে পান কর। সওয়াব পাবে। অনুরূপভাবে যে কনসার্ট করছে, তার উচ্চ আওয়াজ আর নিচু আওয়াজ কি?
আর আপনি তো গানের আয়োজন করেননি। আপনি ওয়াজের আয়োজন করেছেন। আপনি সওয়াবের জন্য এ আয়োজন করেছেন। আপনি কেন মানুষকে কষ্ট দেবেন? আপনার উদ্দেশ্য তো মহৎ। তাই ওয়াজের প্যান্ডেলের বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত মাইক স্থাপন পরিহার করা উচিৎ। মাহফিলের আওয়াজ প্যান্ডেলের মধ্যে সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয়।
প্রতিযোগিতামূলকভাবে মাহফিলের লৌকিক প্রদর্শনী, মাহফিলের নামে উচ্চমাত্রার শব্দযন্ত্রণা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে; তাতে আমরা নিজেরা যদি এখনও আত্মনিয়ন্ত্রিত না হই তাহলে পীড়িত মানুষজন একসময় হয়তো ধৈয্যহরা হয়ে পড়বে। তখন আর কিছু বলার থাকবে না।
উপরন্তু বাসা-বাড়িতে, বাজারে-ঘাটে, দোকানপাটে বহু মানুষ নিজ নিজ পার্থিব কাজে ব্যস্ত থাকেন। কোরআন-হাদিসের আলোচনার আওয়াজ তাদের কানে পৌঁছার পরও তারা যখন দুনিয়ার কাজ ছেড়ে কোরআন-হাদিসের আওয়াজের প্রতি মনোযোগী হচ্ছেন না- তখন তারা তো গাফলতের দোষে দোষী হচ্ছেন। এভাবে গণহারে মানুষকে জোর করে গাফলতের শিকার করাটা দ্বীনী বিবেচনায় মাহফিল আয়োজকদের জন্য কতটুকু সমীচিন হচ্ছে তা-ও ভাবনার বিষয়।
এ ক্ষেত্রে তাবলিগ জামাতের ইজতেমাগুলো আমাদের সামনে আলোকোজ্জ্বল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এক একটা ইজতেমায় কয়েক লাখ মানুষ সমবেত হয়, কিন্তু বয়ানের আওয়াজ প্যান্ডেল থেকে এক শত গজ দূরে শোনা যায় না। মাইক এমনভাবে স্থাপন করা হয় যে, মাইকের আওয়াজ প্যান্ডেলের ভেতরেই সীমিত থাকে।
মাহফিলের ব্যবস্থাপনা কমিটির আরেকটি বড় সমস্যা হলো, তারা মানুষের উপস্থিতিকে মাহফিলের সাফল্যের সূচক বলে জ্ঞান করেন। অথচ উপস্থিতির সংখ্যা মাহফিলের সফলতার সূচক নয় বরং পরিবর্তিত ও সংশোধিত মানুষের সংখ্যা মাহফিলের সাফল্যের সূচক।
মাহফিল শেষ হওয়ার পর কতজন মানুষ উপস্থিত হয়েছিল তা না দেখে দেখুন, কতজন মানুষ বদলে গেছে। ব্যক্তি ও সমাজ বদলানোর লক্ষ্য স্থির করে মাহফিল সাজান। কোন বক্তাকে দাওয়াত করলে মানুষ বেশি উপস্থিত হবে সেই চিন্তা না করে, এভাবে চিন্তা করুন, কোন বক্তা দিয়ে ওয়াজ করালে মানুষ বদলে যাবে।
এভাবে ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নিয়ে, নিয়ম-নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে মাহফিলগুলো আয়োজিত হতো- তাহলে আমাদের মাহফিলগুলো থেকে ইসলাম ও উম্মাহ আরও অনেক বেশি উপকৃত হতো।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৭
এমএইউ/