বাউফল ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ইংরেজীতে পাশ করতে পারেননি।
তার হাতে বাউফল, বরিশাল ও ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮টি হাফেজিয়া মাদরাসা। এসব মাদরাসায় কোরআনের হাফেজ বানিয়েছেন নিজের ছেলেমেয়েসহ তৃতীয় প্রজন্মের নাতি-নাতনিদেরও।
বর্তমানে তার পরিবারে হাফেজের সংখ্যা ৪৬ জন। আর অন্য তরফের আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে তার জ্ঞাতী-গোষ্ঠীদের মাঝে কোরআনে হাফেজের সংখ্যা শতাধিক।
শাহজাহান হাওলাদার ৩ বছর বয়সে মাকে হারান। ৭ বছর বয়সে হারান বাবাকেও। মা-বাবার মৃত্যুর শোক ভুলে একমাত্র বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। ২৬ বছর বয়সে তিনিও হজ পালন করতে যেয়ে মক্কায় ইন্তেকাল করেন।
পরে বোনদের কাছে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকেলও বেশিদূর এগোয়নি। তবে জীবন নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই; কোনো হতাশা নেই।
নিজের পরিবারে হাফেজদের সংখ্যা বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে শাহজাহান হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, বাবা (নুর মোহাম্মদ হাওলাদার) ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তিনি হজ করে এসে দুনিয়ার কোনো কাজ করেননি। তিনি হাফেজদের অত্যাধিক সন্মান করতেন।
বাবা-মা ও ভাইয়ের মৃত্যুর পর অনেকটা এতিম হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন শাহজাহান হাওলাদার। সিদ্ধান্ত নেন বাবা ও ভাইয়ের দেখানে পথে চলবেন আজীবন। সিদ্ধান্ত মতে বাবার রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির কিছু বিক্রি করে বাড়ির পাশে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। বাকী সম্পত্তির আয় দিয়ে মাদরাসার ব্যয় নির্বাহ করতে থাকেন। সেই সঙ্গে নিজের ১০ ছেলে-মেয়েদের হাফেজি পড়ান এবং সবাইকে বিয়ে দেন হাফেজদের সঙ্গে।
বড় ছেলে হাফেজ মাওলানা মজিবর রহমানের বিয়ে হয় হাফেজ মাওলানা মানসুরার সঙ্গে। তারা ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ে নিয়ে সৌদিতে থাকেন। মজিবর রহমানের ৬ সন্তানই কোরআনের হাফেজ।
দ্বিতীয় ছেলে হাফেজ মাওলানা নূর হোসেন বিয়ে করেন হাফেজ শামসুন্নাহারকে। তাদের সংসারে ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। এর মধ্যে ২ ছেলে হাফেজ। তিনি বাউফলের বিলবিলাস দারুল কোরআন নূরানী হাফিজিয়া মাদরাসার পরিচালক। তার স্ত্রীও মাদরাসার শিক্ষক।
তৃতীয় ছেলে হাফেজ মাওলানা আবু বকর বিয়ে করেন হাফেজ নাছিমাকে। বেশ কিছুদিন বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে দারুল আকরাম নামে একটি মাদরাসা পরিচালনা করছেন। তার ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মাঝে ২ জন হাফেজ।
চতুর্থ সন্তান হাফেজ ইবরাহিম বিয়ে করেন হাফেজ মনিরাকে। হাফেজ ইবরাহিম বরিশালের হাটখোলায় পাইকারি শস্যের দোকান পরিচালনা করেন। তাদের সংসারে ১ মেয়ে ৩ ছেলের মাঝে ১ মেয়ে হাফেজ ও ১ ছেলে ১২ পাড়া পর্যন্ত কোরআন মুখস্থ করেছেন।
পরের সন্তান হাফেজ জোবায়ের বিয়ে করেন হাফেজ নাসরিনকে। তিনি বাউফলে ব্যবসার পাশাপাশি আছিয়া খাতুন মহিলা মাদরাসা পরিচালনা করেন। তাদের পরিবারের ২ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের মধ্যে ১ ছেলে হাফেজ ও আরও ১ জন অর্ধেক কোরআন মুখস্থ করেছেন।
হাফেজ হুজাইফা বিয়ে করেছেন মাওলানা হাজেরাকে। হাফেজ হুজাইফা ঢাকার বেগম বাজারে ব্যবসা করেন। তাদের সংসারে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে ১ জন হাফেজ আরেকজনের অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে।
শাহজাহান হাওলাদার তার ৪ মেয়ের মধ্যে হাফেজ খাদিজাকে বিয়ে দেন হাফেজ মাওলানা ইমদাদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বাঁশবাড়িয়াতে একটি হাফিজিয়া মাদরাসা পরিচালনা করেন। তাদের ৪ মেয়ে ও ২ ছেলের মধ্যে ৫ জনই হাফেজ।
দ্বিতীয় মেয়ে হাফেজ আসমার বিয়ে হয় মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে। তিনি রিয়াদে থাকেন। তাদের সংসারে ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। তন্মধ্যে ৫ জনই হাফেজ।
হাফেজ খানজার বিয়ে হয় হাফেজ মাওলানা সোলাইমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকার চিটাগাং রোডে অবস্থিত দারুন নাজাত হাফিজিয়া মাদরাসার পরিচালক। তাদের সংসারে ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে ১ ছেলে হাফেজ আর এক মেয়ে ৮ পাড়া পর্যন্ত মুখস্থ করেছেন।
সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে হাফেজ আম্মারার স্বামী হাফেজ মাওলানা তালহা। তিনি লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক। তাদের সংসারে ৩ সন্তানের মাঝে ১ মেয়ে হাফেজে কোরআন।
শাহজাহান হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, আমি যখন ইচ্ছা করি সব সন্তানকে হাফেজি পড়াব- তখন আমার স্ত্রী এ কাজে সমর্থন করেছেন।
শাহজাহান হাওলাদারের হাতে ১৯৬৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই হাফেজে কোরআন হিসেবে শিক্ষা অর্জন করেছেন।
নানা প্রতিকূলতা, আর্থিক সংকট সত্ত্বেও মাদরাসাগুলো টিকে আছে। তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে এগুলো আরও ভালোভাবে চালানো সম্ভব। মানুষের আরবি শিক্ষার প্রতি প্রচুর আগ্রহ রয়েছে।
তিনি বলেন, বাবার ইচ্ছে আমি পূরণ করেছি। আমি আমার ১০ সন্তানকেই (৬ ছেলে, ৪ মেয়ে) হাফেজে কোরআন বানিয়েছি। মেয়েদেরও বিয়ে দিয়েছি হাফেজদের সঙ্গে। এখন তারা আমার ইচ্ছে পূরণ করে তাদের সন্তানদেরও হাফেজি পড়াচ্ছেন। এখন আমার পরিবারে ৪৬ জন হাফেজ রয়েছেন, পাশাপাশি আরও ৪ জন হাফেজ হওয়ার পথে। বিষয়টি আমার কাছে অনেক গর্বের।
শাহজাহান হাওলাদারের মেজ ছেলে হাফেজ জোবায়ের বলেন, আমিসহ বাবার ছয় ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে সৌদি আরব থাকেন। বাকি সবাই ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন হাফেজিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা ও মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
শাহজাহান হাওলাদার জানান, তিনি এলাকায় ছয়টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মধ্যে ২টি বাউফল উপজেলা সদরে, ২টি বিলবিলাসে ও ২টি বাড়িতে। এসব মাদরাসার তিনটি ছেলেদের ও তিনটি মেয়েদের। এগুলো সন্তানরা পরিচালনা করলেও পুরো দেখভাল তিনিই করেন।
নিজ এলাকায় এমন মহৎ কাজের উদ্যোক্তা পেয়ে স্থানীয়রা বেশ খুশি। এক নামে আশপাশের কয়েকগ্রামের মানুষ শাহজাহান হাওলাদারকে চেনেন। তাদের কাছে তিনি একজন বিনয়ী ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার সন্তাদদেরও এলাকার মানুষ ভালো হিসেবেই জানে। নিজে হজ করলেও আলহাজ বা হাজী শব্দটা নামের আগে পরে ব্যবহার করেন না।
পরিবারের হাফেজের সংখ্যা প্রসঙ্গে শাহজাহান হাওলাদার বলেন, এসব ঘটনা ও কথা এতো বছর চাপিয়ে রাখলেও কীভাবে যে প্রকাশ পেলো; তা আমি জানি না। আমি তো মানুষকে শোনানোর জন্য এসব করিনি। আল্লাহ যেন এ কারণে নারাজ না হন এবং হাফেজে কোরআনের সংখ্যা যেন না কমে যায়- সেজন্য দোয়া করবেন।
বাংলাদেশ সময় : ১৫৪৭ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
এমএস/এমএইউ