সাধারণত কোনো মুমিন বান্দার অন্তরে শয়তান কখনও এ প্ররোচনা দেয় না- অমুক পুণ্যের কাজ করো না, এটা খারাপ কাজ। সোজাপথে মুমিন-মুসলমানকে ধোঁকা দেয় না শয়তান।
তবে আগামী দিন থেকে শুরু করব। আর যখন ‘কাল’ আসবে, তখন সেই আগ্রহ হয়তো থাকবে না। আবার বলবে, আগামীকাল থেকে শুরু করা যাবে। এভাবে ‘আগামীকাল’ তার গোটাজীবনে কখনও আর আসে না। সেই সঙ্গে শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখায়। দুনিয়ার পেছনে ছুটতে উৎসাহী করে। বলে, এভাবে শুধু নামাজ-কালাম নিয়ে থাকলে সংসার চলবে কী করে?
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা প্রিয় বান্দাকে এই বিষয়ে সর্তক করে বলেছেন, ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায়। ’ তাই পূণ্যের আগ্রহ অন্তরে জাগরুক হতেই তাতে অগ্রসর হতে হবে এবং শয়তানের দেওয়া ভয়কে জয় করতে হবে।
নেককাজের উৎসাহ আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আগত এক মেহমান। এ মেহমানের আদর-আপ্যায়ন ও কদর তৎক্ষণাৎই করা উচিত। এর খাতির-যত্ন হচ্ছে এর ওপর আমল করা। মনে করুন, নফল নামাজ পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হলে এই কথা ভাবা যাবে না যে, এ তো ফরজ-ওয়াজিব নয়। না পড়লে কোনো গোনাহ তো আর হবে না। এ কথা ভেবে ছেড়ে দিলে ইসলাহ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত মেহমানের অমর্যদা করা হলো, অবমূল্যায়ন করা হলো। তৎক্ষণাৎ এর ওপর আমল না করা হলে- পিছিয়ে পড়তে হয়।
কারণ এই মেহমান পুনরায় কবে কখন আসবে কিংবা আদৌ আসবে কি-না, তা জানা নেই। মানুষের জীবনের শেষ সময়ের কোনো পূর্বসংকেত নেই। এমনকি নিজের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য কাজের গণ্ডি ও পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হয়। কাজের নিয়ম হলো- দু’টি নেককাজের মাঝে তৃতীয় আরেকটি নেককাজ ঢুকিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ দু’টি নেককাজ পূর্ব থেকে চালু থাকা অবস্থায় তৃতীয় আরেকটি নেককাজের আগ্রহ জাগলে সেটিও সুযোগ বুঝে শুরু করে দেওয়া। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেটিও জীবনের সঙ্গে মানিয়ে যায়।
পার্থিব ব্যাপারে সবসময় নিজের তুলনায় নিচুদের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। পক্ষান্তরে দ্বীন ও আখেরাতের বিষয়ে নিজের তুলনায় উচুঁদের প্রতি। পার্থিব বিষয়ে নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি দৃষ্টি দিলে নিজের প্রতি আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ নিজের সামলে উদ্ভাসিত হয়, নিজের মধ্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হয়।
পক্ষান্তরে দ্বীনী বিষয়ে যখন নিজের তুলনায় উচুঁদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে এবং ভাববে- অমুক ব্যক্তি তো দ্বীন-ধর্ম ও নেককাজে আমার চেয়ে অগ্রগামী, তখন নিজের দোষ-ত্রুটিগুলো পরিলক্ষিত হয়। নেককাজের অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং নেক আমলের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা আসে।
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ইসলামি স্কলার হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) বলেন, ‘আমি জীবনের প্রথম সময়টা বিত্তশালীদের সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি নিজেও ধনাঢ্য ছিলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধনবানদের সঙ্গে কাটাতাম। যখন আমি বিত্তবানদের সঙ্গে ছিলাম, তখন আমার চেয়ে অধিক বিষন্ন বোধহয় আর কেউ ছিলো না। কেননা যেখানেই যেতাম- দেখতাম অমুকের বাড়িঘর আমার চেয়ে উন্নত, অমুকের যানবাহন আমার অপেক্ষা মূল্যবান, তার পোশাক-পরিচ্ছদ আমার চেয়ে দামি; তখন এতে আমার অন্তর বিষন্নতায় ছেয়ে যেত। ভাবতাম, আমি এসবের কিছুই পেলাম না অথচ তার সবই হয়ে গেল!’
তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে যখন দুনিয়ার হিসেবে নিম্নবিত্তের লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করলাম এবং তাদের সঙ্গে ওঠা-বসা আরম্ভ করলাম- তখন আমি খুবই আত্মপ্রশান্তি লাভ করলাম। কারণ, এরপর থেকে যাকেই দেখি, মনে হয় আমি তো বড় সুখ-স্বাচ্ছন্দেই রয়েছি। আমার পানাহার তার চেয়ে উন্নতমানের, আমার পোশাক-পরিচ্ছদ তার চেয়ে বেশি দামি, আমার বাড়ি-ঘর তার চেয়ে উৎকৃষ্ট, আমার যানবাহনও তার চেয়ে মূল্যবান। অতএব আলহামদুলিল্লাহ আমি বড় সুখে-শান্তিতেই আছি। ’
যদি কোনো মানুষের একটি স্বর্ণের উপত্যকাও হস্তগত হয়, তবে সে বলবে- আমার দ্বিতীয় আরেকটি স্বর্ণের উপত্যকা চাই। আর যখন দু’টি পেয়ে যাবে তখন বলবে, তৃতীয় আরেকটি পেতে যাই। আর এভাবেই দৌড়-ঝাঁপের মাঝে জীবনায়ু ফুরিয়ে যাবে। কখনও প্রশান্তির ঠিকানায়, পরিতৃপ্তি এবং স্থীরতার মনজিলে পৌঁছাতে পারবে না। তাই শয়তানের এই প্ররোচণা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে অন্তরে আগত পূণ্যের আগ্রহকে জিইয়ে রেখে নেক আমলে ব্রতী হতে হবে। আর এতেই রয়েছে সফলতা নিহিত।
লেখক: মুহাদ্দিস, ইমাম ও প্রাবন্ধিক
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৭
এমএইউ/