গাজীপুরের কালিয়াকৈর ঢুকতেই যানজট যেন আরও জেঁকে বসলো। যেনো ঢাকা ত্যাগের জটকেও হার মানাবে! ঘড়ির কাঁটা তখন বলছে, সময় ৬টা বেজে ২৬ মিনিট।
সুপারভাইজার মোহাম্মাদ জিন্নাহ তখনও ধৈর্য চর্চায় মগ্ন হয়ে চুপ, কারণ তার অভিজ্ঞতা তো রোজকার। মিনিট দশেক পরেই বাঁ পাশে দৃশ্যমান হতে লাগলো খাবার হোটেল। অতো বড় নয়, সাধারণ ভাতের হোটেলগুলো ইফতার হোটেলে সাজ নিয়েছে! সেখানকার কর্মচারীরা হাত নেড়ে ডাকতে থাকলেন। তবে জিন্নার পরামর্শে আরেকটু সামনে গিয়ে শিলাবৃষ্টি পাম্পে (ফাইভ স্টার সুপার মার্কেটও বলা হয়) গিয়ে থামা। সেখানেই বুধবার (১৪ জুন) ইফতারি বিরতি।
বাইরে বিক্রেতা খাদ্য পদ নিয়ে বিক্রিতে ব্যস্ত, আয়েশ করে যারা বসে খেতে চান তাদের আনাগোনা হোটেলের ভেতরে। এক দোকানে ইফতার ফল ছাড়া প্লেট ৮০, অনেক দোকানে ফলসহ ১০০ টাকা। দামটা ১০-২০ টাকা বেশিই, বিড়বিড় করে বলছিলেন অনেকে।
বাস থেকে যাত্রীরা একে একে নেমে কেউ ঢুকলেন ভেতরে, আবার কেউবা বাইরে থেকে কিনে ইফতারি সারতে আজানের জন্য অপেক্ষারত।
এরই মধ্যে কোন এক গাড়ি একটু দেরিতে এসে পৌঁছুলে সেখানকার যাত্রীদের দ্রুত ইফতার পরিবেশনে সবার আত্মনিয়োগ। ভেতরে চাপাচাপি করে বসতেও যেন নেই অনিহা। কেউ রংপুর রুটের, কেউ গাইবান্ধা কিংবা রাজশাহী-বগুড়া, সবাই সবার আপন। আজান পড়লে নিজের এক ঢোক খাওয়া পানির বোতল পাশের জনকে দিতেও যেন সেকেন্ডের দেরি নয়। সবার হাসিমুখ।
বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম রোজা ছিলেন। তবে এক ক্রেতা রোজা ভেঙে ছোলা খাওয়ার কথা বলতেই হাতের থালা রেখে তাকে বেড়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য ছিল না। এ যেন পেশাদারিত্বের থেকেও তার নিজেকে আরেকটু বাড়তি বিলিয়ে দেওয়া।
নূর মোহাম্মাদ, আরেক বিক্রেতা। কথা প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ইফতারিতে ভালোই লোক হয়। সেহরিতে তার থেকে খানিক বেশি হয়। আমরা অনেক ইফতার আয়োজন করি, যাতে কারো কম না পড়ে। সেহরিতেও তাই।
পাশ থেকে আরিফুল বলে বসলেন, দেখেন কতগুলো থেকে গেলো- এগুলো সবই ফেলে দিতে হবে, যাত্রীদের পূর্ণ চাহিদা মেটাতেই একটু বাড়তি রান্নাবাড়া হয় আরকি।
খুব মন দিয়ে খাওয়া যাকে বলে, ঠিক তেমনই দেখাচ্ছিল লম্বা এক ব্যক্তিকে। আজান হওয়ার পর থেকেই তিনি খেতে শুরু করেন, প্রায় মিনিট সাতেক পেট পুরে বললেন, ‘‘ভালোই হইসে বুন্দিয়াটা, ছোলা আর ছোট বড়া দিয়ে খেলাম, ভালোই লাগলো’’।
ভাই কি রংপুর যাচ্ছেন? ‘‘আমার বাড়ি গাইবান্ধা, সেখান থেকে এলাম। ঢাকা যাচ্ছি। উত্তরায় অফিসে যোগ দেবো কাল (বৃহস্পতিবার-১৫ জুন)’’।
কী করেন? ‘‘আমি পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় আছি, নাম সুজন সরকার। ’’
টুকটাক অন্য কথার মাঝে একটু থেমে তিনি বললেন, ‘‘আমি অন্য ধর্মের, কিন্তু ইফতারি মিস নেই। সবখানেই ইফতার মানে আনন্দ, সারাদিন নিজেকে বিরত রাখার পরের আত্মপ্রকাশ। এখন সফরে, তবুও ইফতারি মিস করতে চাই না। দেখছেন না ধনী-গরিব সবাই কেমন করে এক কাতারে এসে খাচ্ছে। এটা ইফতার ছাড়া অন্য কোনো বেলা হলে সম্ভব হতো না। ’’
‘‘হাইওয়েতেও ইফতারি, সেহরির পূর্ণ আনন্দ, নাড়া দেয় আমাদেরও,’’ বলেন জিন্না। তাদের মতো কর্মীদের ইফতার নাড়া দেয় কর্মক্ষেত্রে। যাদের জীবন কাটে সুভারভাইজার হিসেবে পথে-পথে। বাড়ির সঙ্গে ইফতার করার মতো সুযোগ রমজানের হুটহাট দিন ছাড়া না এলেও তারাই যাত্রীদের আপন করে নিয়ে সময়টা করে দেন সুখকর।
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৭
আইএ/জেডএম