সাম্প্রতিককালে ইসলামের প্রতি রাশিয়ার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের পররাষ্ট্রনীতিতেও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জোরদার করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ঈদ উপলক্ষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ ও মুসলিম নেতারা মুসলমানদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে থাকেন।
কয়েক দশকের মধ্যে এবার রাশিয়ায় বসবাসরত মুসলমানদের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী রোজা পালন করতে হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলভেদে মুসলমানরা ১৭ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা পালন করেছেন।
ঈদের দিন রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে এক দিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়। মস্কোতে এবার রমজান শেষে ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৫ জুন রোববার। দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পড়ায় স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বাড়তি আনন্দ দেখা গেছে।
মস্কোতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় মসজিদে। মসজিদটি মস্কোর ক্যাথেড্রল মস্ক ও জুমা মসজিদ নামেও পরিচিত। এটি ইউরোপের অন্যতম বড় মসজিদ।
চার বছর আগে এটি ভেঙে ১০ হাজার নামাজির স্থান সংকুলানের উপযোগী করে নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। এর বর্তমান আয়তন ১৯ হাজার বর্গমিটার। তুরস্কের ধর্মবিষয়ক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টার্কিশ ডেয়ানেট মসজিদটির অভ্যন্তরীণ ডিজাইনের ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছে।
২০১৬ সালের পবিত্র হজের দিন মসজিদটি উদ্বোধন করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, কাজাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান নাজারবয়েভ, রাশিয়ায় নিযুক্ত বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূত, বিশ্বের খ্যাতিমান ইসলামি স্কলার ও রাশিয়ার ঊর্ধ্বতন সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা।
ইউরোপের অন্যতম বড় এ মসজিদে একসঙ্গে ১০ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারলেও এবার ঈদের জামাতে আড়াই লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন। মসজিদের ভেতরে জায়গা না হওয়ায় বহু মানুষ রাস্তায় নামাজ পড়েছেন। এটা ইউরোপের সবেচেয়ে বড় ঈদের জামাত।
এজন্য নগর কর্তৃপক্ষ পুরো এলাকাটি ঘিরে সেখানে গাড়ী প্রবেশ বা চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল রাশিয়া ওয়ান কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে ঈদের জামাত ও খুতবা সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
মস্কোতে একসঙ্গে এতো মানুষের অংশগ্রহণে ঈদের জামাতের ছবিটি প্রমাণ করে ইসলামের আলোকধারা দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে আপনগতিতে।
অথচ এই মস্কোসহ রাশিয়াতে একসময় অনেক মসজিদ থাকলেও সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পানশালা আর ক্লাবঘরে পরিণত করা হয় আল্লাহর ঘর মসজিদগুলোকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে মসজিদগুলো খুলে যায়। শুরু হয় মসজিদে আবার নামাজ, আজান ও কোরঅান তেলাওয়াত।
নতুন মসজিদ তৈরিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর বিশাল মসজিদটি এই সুযোগেরই স্বাক্ষর। এই মসজিদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইসলামিক কালচারাল সেন্টারও। কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে এ সেন্টারে।
মস্কোর এই মসজিদটিকে কেন্দ্র করে ঈদ জামাতের জন্য বিপুলসংখ্যক মুসল্লির সমবেত হওয়া মস্কোর জন্য নতুন ও মধুর একটি দৃশ্য বটে। একসময় যেখানে অনেকের পক্ষে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব, সেখানে ঈদের দিন এত বড় সমাবেশ অকল্পনীয় এক ব্যাপার।
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিকাশের যুগেও কোথাও কোথাও যেখানে মুসলমানদের রোজাপালনে বাধা দেওয়া হয়েছে সেখানে মস্কোতে আড়াই লাখ মুসল্লির একসঙ্গে ঈদ জামাত বিরাট ঘটনা বটে।
মস্কোর এ মসজিদকে ঘিরে কোরআন শিক্ষাসহ আরও দীনী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আসলে শাশ্বত কোরআনের আলো যেখানে পৌঁছে যায়, সেখান থেকে অন্ধকার অপসারিত হবে এটাই চিরসত্য। মস্কোতেও তাই ঘটছে বলে আমরা মনে করি।
অন্যথায় মুসলিম বলে যেখানে পরিচয় দেওয়া ছিল দুরহ বিষয়, সেখানে এতোবড় ঈদের জামাত; তা কি ভেবেছিলেন কেউ? নিশ্চয়ই না। কিন্তু তা এখন বাস্তব। আলোর বন্যায় উপচে পড়ছে রাশিয়ার রাজধানী মহানগরী মস্কো। সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। কোনো হৈ চৈ নেই, হুড়োহুড়ি নেই। মহাসড়কের সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছগাছড়া বাঁচিয়ে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট না করে চমৎকারভাবে জামাত সম্পন্ন করে তাকবির দিতে দিতে ঘরে ফিরে গেছেন সব মুসল্লিরা।
এ দৃশ্য দেখে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা অভিভূত। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকলেও তাদের প্রায় নির্বিকার থাকতে হয়েছে।
আমরা মনে করি, মস্কো মহানগরীর দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ও সেদেশের সরকার নিশ্চয়ই মুসলিমদের ঈদ বা কালচারাল অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে সহানুভূতিশীল। অন্যথায় এতো মানুষের অংশগ্রহণের ঈদের জামাত নির্বিঘ্ন হতে পারে না। এছাড়া যারা বিশাল এ জামাতের আয়োজন করেছেন তাদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়েছে। মস্কোর এ আলোকধারা অব্যাহত থাকুক, আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
-দ্য মুসলিম টাইমস অবলম্বনে
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৭
এমএইউ/