হজের অন্যতম বিধান হলো- শয়তানের প্রতীকী ৩টি স্তম্ভে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। মাথার চুল মুণ্ডন অথবা কাটার পূর্বে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়, এটা ১০ জিলহজের দিনের ওয়াজিব আমল।
যা গতকাল (শুক্রবার) হাজিরা পালন করেছেন। এর পর হাজিরা তাওয়াফে জিয়ারত বা ফরজ তাওয়াফ ও সাঈ করার জন্য মক্কায় এসেছেন। তাওয়াফ-সাঈ শেষে কেউ মিনার তাঁবুতে ফিরে গেছেন। মিনার তাঁবুতে অবস্থান আজ (১১ জিলহজ বা ২ সেপ্টেম্বর) ও আগামীকাল (১২ জিলহজ) কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন।
অনেকেই আবার মক্কায় থেকে গেছেন। তারা মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন এই দুই দিন।
এদিকে সৌদিতে গতকাল শুক্রবার ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। আর হাজিরা মিনায় অবস্থান করার কারণে মক্কা বেশ ফাঁকা ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। ফলে মক্কার খাবারের হোটেলে ও সেলুনে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। এই সুযোগে হোটেলে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মাথা মুণ্ডণে চারগুণ দাম নেওয়া হয়। মাথা
ন্যাড়া করতে অন্য সময় ৫ রিয়াল করে লাগলেও কাল অনেককে ২০ রিয়াল পযর্ন্ত গুণতে হয়েছে।
হানাফি মাজহাব মতে যারা তামাত্তু ও কিরান হজ করেন- তাদের জন্য তিনটি কাজের ধারাবাহিকতা ওয়াজিব। সেগুলো হলো- প্রথমে কঙ্কর নিক্ষেপ, এরপর কোরবানি, তারপর চুল ন্যাড়া কিংবা ছোট করা।
যে ব্যক্তি ইফরাদ হজ পালন করে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, বিধায় সে প্রথমে কঙ্কর নিক্ষেপ করবে, এরপর চুল মুণ্ডন করবে।
কঙ্কর নিক্ষেপে সাতের সংখ্যা পূর্ণ করা ওয়াজিব। প্রথম দিন ছাড়া অন্যান্য (১১ ও ১২ জিলহজ) দিনে একুশের সংখ্যা পূর্ণ করা ওয়াজিব। কেউ যদি প্রথম দিনে চারটি মেরে তিনটি ছেড়ে দেয়, অন্যান্য দিনে এগারোটি মেরে দশটি ছেড়ে দেয়, তবে যথেষ্ট হবে, কিন্তু ছেড়ে দেওয়া প্রত্যেক কঙ্করের বিনিময়ে এক ফিতরা সদকা করা ওয়াজিব।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কঙ্কর মারা ওয়াজিব। কেউ কোনো দিনের কঙ্কর মারা ছেড়ে দিলে সেটা পরের দিন কাফফারাসহ কাজা করা ওয়াজিব।
কঙ্কর নিক্ষেপের সুন্নত ও মুস্তাহাবসমূহ
১. কঙ্কর বিরতি ছাড়া একের পর এক মারা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। যদি কেউ দু’টি কঙ্কর একের পর এক এভাবে নিক্ষেপ করে যে, একটি নিজের পক্ষ থেকে এবং অপরটি অন্যের পক্ষ থেকে, তবে এটা জায়েয। কিন্তু সুন্নত তরক করার কারণে মাকরূহ।
২. প্রথমে জামারায়ে উলা, এরপর জামরায়ে উস্তা, এরপর জামরায়ে আকাবায় ধারাবাহিকভাবে কঙ্কর নিক্ষেপ করা সুন্নত। যদি কেউ এর উল্টো কঙ্কর নিক্ষেপ করে এবং সেদিনই স্মরণ হয়, তবে জামরায়ে উস্তা ও আকাবায় পুনরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
৩. কঙ্কর নিক্ষেপের সময় কাবাকে বামদিকে এবং মিনাকে ডানদিকে রাখা সুন্নত।
৪. জামরায়ে থেকে পাঁচ হাত কিংবা আরও বেশি দূরত্বে দাঁড়িয়ে কঙ্কর মারা সুন্নত। এর কম দূরত্বে থেকে কঙ্কর মারা মাকরূহ।
৫. ডান হাতে কঙ্কর মারা মুস্তাহাব। প্রত্যেক কঙ্কর নিক্ষেপের সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা সুন্নত।
৬. প্রত্যেক দিন ছোট শয়তান ও মেজ শয়তানকে পাথর মারার পর দোয়া, হামদ, তাকবির ইত্যাদির জন্যে কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়ানো সুন্নত।
৭. জামরায়ে আকাবার পাথর মারার পর কোনো দিনই দোয়ার জন্য দাঁড়ানো উচিত নয়।
৮. ছোট নাপাকি ও বড় নাপাকি থেকে পাক অবস্থায় কঙ্কর মারা সুন্নত।
৯. কঙ্করগুলো খেজুরের আঁটি কিংবা মটরের দানার সমান বড় হওয়া মুস্তাহাব।
১০. মুজদালিফা থেকে পাথর কুড়িয়ে সেই পাথর নিক্ষেপ করা মুস্তাহাব।
১১. মুজদালিফা ছাড়া অন্য জায়গা থেকেও পাথর কুড়ানো জায়েয। তবে জামরার নিকটবর্তী স্থান, মসজিদ এবং নাপাক জায়গা থেকে কঙ্কর কুড়ানো মাকরূহ।
১২. নিক্ষেপ করার পূর্বে কঙ্করগুলো ধুয়ে নেওয়া মুস্তাহাব।
১৩. চতুর্থ দিনে পাথর নিক্ষেপের জন্যে মিনায় অবস্থান করা মুস্তাহাব। এতে ইবাদতের পূর্ণতা লাভ করে।
কঙ্কর নিক্ষেপের মাকরূহ
১০ তারিখ দ্বি-প্রহরের পরে কঙ্কর মারা।
বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করা। বড় পাথর ভেঙ্গে ছোট ছোট খণ্ড তৈরি করা। জামরার নিকট থেকে পাথর কুড়িয়ে নিক্ষেপ করা।
কঙ্কর নিক্ষেপের শর্তাবলী
১. কঙ্কর সত্যিকার অর্থে নিক্ষেপ করতে হবে। জামরার জায়গায় রেখে দেওয়া নয়। সুতরাং কেউ যদি কঙ্কর তুলে জামরার জায়গায় রেখে দেয়, তবে এটা জায়েয হবে না। কেননা, একে নিক্ষেপ করা বলা হয় না।
তিন হাত কিংবা আরও বেশি দূর থেকে কঙ্কর ছুঁড়ে মারলে তাকে নিক্ষেপ করা বলা হয়।
২. হাতে নিক্ষেপ করতে হবে। সুতরাং তীরের সাহায্যে নিক্ষেপ করলে কিংবা পা দিয়ে ঠেলে দিলে জায়েয হবে না।
৩. জামরার গায়ে কিংবা অদূরে পাথর মারতে হয়। জামরা থেকে দূরে পতিত হলে জায়েয হবে না। দূরে ও অদূরের মাপকাঠি হচ্ছে তিন হাত। অর্থাৎ তিন হাত দূরে পতিত হলে জায়েয এবং এর বেশি দূরে পতিত হলে নাজায়েয।
৪. প্রত্যেক জামরায় সাতটি কঙ্কর আলাদা আলাদা নিক্ষেপ করা শর্ত। যদি একাধিক পাথর কিংবা সাতটি পাথরই এক দফায় নিক্ষেপ করে। তবে সেটা একাধিক পাথর গণ্য হবে এবং এবং সুন্নত বিরোধী হওয়ার কারণে এটা মাকরূহ হবে।
৫. কঙ্কর নিজে নিক্ষেপ করতে হবে। সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বিনা ওজরে অন্যের দ্বারা কঙ্কর নিক্ষেপ করানো জায়েয নয়। ওজর থাকলে জায়েয। সুতরাং কোনো রোগীর পক্ষ থেকে তার আদেশে অন্য ব্যক্তি কঙ্কর নিক্ষেপ করলে জায়েয হবে। যদি কঙ্কর নিক্ষেপের পর সময়ের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তবে তাকে পুনরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।
যদি রোগী কঙ্কর নিক্ষেপ না করে এবং তার পক্ষ থেকেও কেউ কঙ্কর নিক্ষেপ না করে, তবে ফিদিয়া দেওয়া ওয়াজিব।
৬. কঙ্কর মাটি জাতীয় হওয়া চাই অর্থাৎ পাথর হোক কিংবা যে বস্তু দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েয, তা দ্বারা রমি করাও জায়েয।
যদি কেউ সাতটি কঙ্কর না মারে, বরং চার কিংবা আরও বেশি কঙ্কর মারে এবং তিন কিংবা আরও কম ছেড়ে দেয়, তবে কঙ্কর নিক্ষেপের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু ছেড়ে দেওয়া প্রত্যেক পাথরের বিনিময়ে এক ফিতরা পরিমাণ সদকা করা ওয়াজিব।
আর যদি অধিকাংশ ছেড়ে দেয়, তবে তার ওয়াজিব আদায় হবে না। ফলে তার ওপর দম ওয়াজিব হবে। এটা প্রথম দিনের কথা। এদিন এক জামরাতেই পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। অন্যান্য দিনে প্রত্যেহ তিন জামারায় মোট ২১টি কঙ্কর মারতে হয়। ফলে সেদিন অধিকাংশ হবে এগারোটি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৭
এমএইউ/জেডএম