উহুদ প্রান্তরে কোরায়েশরা নির্মমভাবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহিদ করেছিল, তাকে আহত করেছিল। এই রণক্ষেত্রে নবী করিম (সা.)-এর চাচা মহাবীর হজরত হামজা (রা.) এবং হজরতআকিল ইবনে উমাইয়া (রা.)সহ সত্তরজন সাহাবা শহিদ হয়েছিলেন।
হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত আকিল (রা.) কে একই কবরে দাফন করা হয়। পরে উহুদ প্রান্তরে এখন একটি সুদৃশ্য মসজিদ নিমাণ করা হয়েছে। রয়েছে হজরত হামজা (রা.)-এর নামে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মসজিদের সামনে উহুদ যুদ্ধের শহিদদের কবরস্থান। হজপালনকারীরা উহুদ প্রান্তরে এসে শহিদদের কবর জিয়ারত করে থাকেন।
কবরস্থানটির প্রাচীর মূল কবর থেকে অনেক দূরে। মূল কবরগুলোকে সামান্য ইট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। প্রাচীরের চারপাশের গ্রিলের ফাঁকগুলো মোটা পলিথিন দিয়ে ঘিরে রাখা। খুব সহজে কবরগুলো দেখা যায় না। তার পরও দশনাথীরা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে, পলিথিনের আবরণ সরিয়ে কবর দেখার চেষ্টায় ত্রুটি করেন না।
উহুদ প্রান্তরের কবরগুলো পার হয়ে সামনে এগুলে ছোট্ট একটি পাহাড়। এ পাহাড়কে অনেকেই রুমার পাহাড় বলে থাকেন। তবে এর আসল নাম জাবালে রুমাত। উহুদ যুদ্ধের সঙ্গে এই পাহাড়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই পাহাড়ে নবী করিম (সা.) ৫০ জন তীরন্দাজকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করেছিলেন।
তীরন্দাজদের এখানে মোতায়েনেরে সময় নবী করিম (সা.) বলেছিলেন, নিদেশ দেওয়ার আগ পযন্ত তারা কোনো অবস্থায়ই তাদের স্থান থেকে যেন সরে না আসে। তিনি নিদেশ হিসেবে বলেন, ‘তোমরা আমাদের পেছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে আমরা গনিমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে না। ’
এখন এই পাহাড়টিতে উঠা যায়। তবে উহুদ পাহাড়কে দূর থেকে দেখতে হয়। উহুদ পাহাড়টির অবয়ব এখনও অনেকটা অক্ষুন্ন এবং উহুদের পাহাড়ের রঙ অন্যসব পাহাড় থেকে একটু ভিন্ন।
হাদিসে এই পাহাড় সম্পকে প্রচুর বণনা রয়েছে। এক বণনায় নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। ’ এ ছাড়া অনেক হাদিসে, সওয়াবের পরিমাণ বুঝাতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উদাহরণ হিসেবে বলেছেন উহুদ পাহাড়ের কথা বলেছেন।
ইসলামি স্কলাররা বলেন, উহুদ পাহাড় ইতিহাসের সাক্ষী। জীবনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিদেশনা না মানলে মুসলিমরা কী পরিমাণ দুভোগে পড়বে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ উহুদের প্রান্তর। এই শিক্ষা শুধু যুদ্ধের দিনের নয়, পুরো জীবনের।
উহুদের যুদ্ধ ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল তারিখে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এর আগে এই দুইপক্ষের মধ্যে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। ওই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন।
উহুদের যুদ্ধে কোরায়েশদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো তিন হাজার। আর মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিলো এক হাজার। তন্মধ্যে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। ফলে মাত্র ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমদের যুদ্ধ করতে হয়।
যুদ্ধের এক পযায়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় অনেক মুসলিম সেনা মারা যায়। নবী করিম (সা.) আহত হন এবং তার একটি দাঁত ভেঙে যায়। শুরু হয় তীব্র লড়াই। পরে মুসলিম সেনারা উহুদ পাহাড়ের ঢালে জমায়েত হয়। কোরায়েশরা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ও মুসলিমদের একটি দলের প্রতিরোধের কারণে বেশি এগোতে সক্ষম হয়নি। ফলে লড়াই থেমে যায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীদের তিনদিন অবস্থানের তৎকালীন রীতি পালন না করে কোরায়েশরা মক্কায় ফিরে যায়। ফলে শেষপযায়ে মুসলিমদের তুলনামূলক বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও কোরায়েশদের সুবিধাজনক অবস্থান সত্ত্বেও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।
উহুদ প্রান্তরে আহত অবস্থায়ও নবী করিম (সা.) বারবার বলছিলেন, ‘হে পরওয়ারদেগার! আমার কওমকে ক্ষমা করে দাও, ওরা জানে না। ’ –সহিহ মুসলিম
মুসলিম সেনাদের পাশাপাশি উহুদ যুদ্ধে মুসলমান মহিলাদের ভূমিকাও ছিলো অনন্য। উহুদের যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহিদ হয়েছেন। আর কোরায়েশদের ৩৭ জন নিহত হয়েছিলো। এই যুদ্ধে মক্কার সৈন্যরা মুসলমানদের কোনো শিবির দখল করতে এবং কাউকে বন্দীও করতে পারেনি। কাফেররা কোনো গনীমতের মালও হস্তগত করতে পারেনি।
এই যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের ৫০টি আয়াত নাজিল হয়েছে। বস্তুত ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে সঙ্কট ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো এর মধ্যে আল্লাহর হেকমত লুকায়িত। এর অন্যতম হলো- বিপদে ধৈয ধারণ করতে হবে। এটা খাঁটি ঈমানের লক্ষণ এবং মুসলমানদের চিরন্তন শিক্ষা। জীবনে এই শিক্ষা ধারণের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৭
এমএইউ/এসএইচ