কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দিলো আমেরিকা। যদিও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ থেকে এ স্বীকৃতির তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে।
আমেরিকার এমন হঠকারী ও বালকসুলভ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে শুধু ব্যাহতই করছে না, ওই অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে; যা প্রকারান্তরে ইসরাইলের আধিপত্যবাদী নীতিকে আরও উৎসাহিত করছে।
জেরুজালেম মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান তিন ধর্মাবলম্বীর কাছেই অতি পবিত্র একটি নগরী। মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এ নগরীতেই অবস্থিত। যে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর নবী হজরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন ফিলিস্তিনকে তিনটি পৃথক সত্তায় বিভক্তির পরিকল্পনা করে- ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল, আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম।
বলা হয়েছিলো, জেরুজালেম হবে আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত নগরী। ব্রিটিশ শাসনাবসানের পর ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে জেরুজালেমের পশ্চিম অংশ দখল করে নেয় ইসরাইল। শহরটির পূর্ব অংশ থাকে ফিলিস্তিন ও জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গোটা জেরুজালেম চলে যায় ইসরাইলের দখলে।
তখন থেকে নগরীটিকে ইসরাইল তাদের রাজধানী করতে চাচ্ছে এবং ১৯৮০ সালে রাজধানী হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছে, যদিও এখন পর্যন্ত তেলআবিব দেশটির রাজধানী।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধানের ক্ষেত্রে পশ্চিম তীর ও গাজার সমন্বয়ে যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা, ফিলিস্তিনিরা চায় তার রাজধানী হোক পূর্ব জেরুজালেম। তাদের এ চাওয়া ন্যায়সঙ্গতও বটে। কারণ পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ বাস্তবতায় গোটা জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করা হলে ফিলিস্তিনিরা যে কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
সেক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি সংকট আবারও গভীর হয়ে উঠতে পারে। এরইমধ্যে ‘ইনতিফাদা’ বা স্বাধীনতা আন্দোলন এর ডাক দিয়েছে হামাস।
ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আমেরিকা বরাবরই ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার মূল সুর মেনে তাদের প্রকাশ্য অবস্থান সবসময়ই ছিলো বিবাদমান দুই দেশের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে জেরুজালেমের ভাগ্য নির্ধারণের পক্ষে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে নির্বাচিত হলে জেরুজালেমের ওপর ইসরাইলের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। গত বুধবারের ঘোষণা ট্রাম্পের সেই আগের ঘোষণারই বাস্তবায়ন। কিন্তু এটি খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। কেননা, ট্রাম্পের এই হঠকারী ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ মধ্যস্ততাকারী হিসেবে যোগ্যতা হারিয়েছে বলে এরই মধ্যে জানিয়েছে আরব বিশ্ব।
তাই ট্রাম্প তার নতুন অবস্থান থেকে না সরলে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দেশটিকে বুঝতে হবে, ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ইসরাইলের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে অধরাই থেকে যাবে শান্তি। ভুলে গেলে চলবে না, আজ যে রাষ্ট্রটি ইসরাইল, একসময় সেটাই ছিল ফিলিস্তিন। ইসরাইলিরা সেই ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ায় বর্তমানে ফিলিস্তিনিরা কেবল পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের স্বীকৃতি চায়।
কিন্তু সেটুকুও বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ছেড়ে দিতে ইসরাইল নারাজ। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই পারত এ ব্যাপারে ইসরাইলকে নমনীয় করতে। এর বদলে একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় সে আশাও দুরাশায় পরিণত হলো।
জেরুজালেম নিয়ে মার্কিন ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববাসী। ফ্রান্স, রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, চীন ও সৌদি আরবসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্ররাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেছিল। এমনকি পোপ ফ্রান্সিসও জাতিসংঘ প্রস্তাবনা অনুসারে জেরুজালেমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনক, তিনি এ ব্যাপারে কারও কথায় কর্ণপাত না করে খুশি করলেন শুধু ইসরাইলকে। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য একটি দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অনিশ্চয়তা থেকে বেরোতে পারছে না। তার ওপর ট্রাম্পের নতুন ঘোষণা নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
ঐতিহাসিকদের মতে, জেরুজালেম দখলের পর থেকে ইসরাইল জেরুজালেমকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করলেও এ দাবীর কোনো যৌক্তিক বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমসহ এই শহরগুলোর আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চল আল্লাহতায়ালার বিশেষ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সে জন্য এসব এলাকাতেই এসেছেন বিখ্যাত সব নবী-রাসূল। এখান থেকে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে আল্লাহর সব নির্দেশাবলি। আর এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দুনিয়া। আল্লাহ প্রেরিত সেই অগণিত নবী-রাসূল এবং তাদের সহযোগীরাই ছিলেন এ অঞ্চল তথা জেরুজালেম গড়ে তোলার প্রধান কারিগর। এ ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রস্তাবনায় জেরুজালেমের ওপর ইসরাইলের দাবীকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করে।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনের ওপর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং সব ধর্মের মানুষ সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সব সময়ই ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আসছে। জেরুজালেমের অবমুক্তি ও মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সর্বদা অঙ্গিকারাবদ্ধ।
তাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যেমন এই ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি, আমরাও সঙ্গত কারণে ট্রাম্পের এ ঘোষণায় তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে আশা করি, এ ঘোষণা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে আমেরিকা দুই দেশ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে জরুরি পদক্ষেপ নেবেন। আমরা মনে করি, আমেরিকার সাধারণ নাগরিকরাও ট্রাম্পের এ ঘোষণা সমর্থন করেন না।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭
এমএইউ/