পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ''নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর প্রতি সালাত (রহমত) প্রেরণ করেন আর তার ফিরিশতাগণও নবীর প্রতি সালাত (দোয়া) পাঠান। হে মুমিনগণ! তোমরাও তার প্রতি সালাত (দুরূদ) পাঠ করো এবং সালাম পাঠাও,'' (সুরা আহযাব: ৫৬)।
সর্বদা তার উপর দরূদ ও সালাম পেশ করে থাকেন।
মহানবীর আগমনে ঊষর ইয়াসরিব নামের প্রাচীন আরবের নগরীটি ফুলে-ফলে-ফসলে সবুজ হয়ে ওঠে। হিজরতের সময় নবীর আগমনকে ঘিরে নগরী সঞ্জীবিত হয়। আনন্দে সবাই ছিল আত্মহারা। শিশুরা সমস্বরে সেদিন গেয়েছিল: ''ত্বায়ালা আল বাদরু আলাইনা/মিন ছানিয়াতিল ওয়াদায়ি/ওয়জ়াবাশ শুকরু আলাইনা/মা দাআ লিল্লাহি দায়ী। ''যার অর্থ হলো: স্বাগতম, হে নবী তোমায় সানিয়াতিল বিদার উপত্যকায় অভিনন্দন! হে প্রিয় অতিথি; এসো ওগো, পূর্ণিমার তিথি। আমাদের মাঝে এসেছেন, তাই কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধাবনত সবাই, সুপথে চলার, তুমিই মহান দিশারী।
মানবতার দূত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভিবাদন ও সালাম জানানোর আকুতি সব মুসলমানের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি রচনায় পবিত্র কাবা গৃহ জিয়ারতকারী মক্কা-মদিনার পথের যাত্রীদের কাছে মিনতি জানিয়ে বলা হয়েছে, ''আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওজায়''।
পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান নর ও নারী যে স্থান থেকে যখনই নবীর প্রতি সালাম ও দরূদ পেশ করেন, তা ফেরেশতারা মদিনায় পৌঁছে দেন। মদিনায় এলে নবীর রওজাপাকের সামনে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে নিজের এবং পরিবার-পরিজন, স্বজনদের পক্ষ থেকে সালাম জানান মুসলিমগণ। দরূদ ও সালামে মুখরিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে নবীর রওজা শরিফের সামনে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হন।
শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) বিশেষ ভিড় দেখা যায়। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সমবেত হন রওজায়। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে গভীর ভালোবাসায় মদিনায় ছুটে আসা মানুষ সালাম নিয়ে হাজির হন নবীর দরবারে। মূলত বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতকে শুক্রবার রাত ধরা হয়। কারণ ইসলামের চন্দ্রভিত্তিক পঞ্জিকায় রাত আগে আসে।
মদিনার আরেক মুবারক বৈশিষ্ট্য হলো সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন। কারণ, নবী সপ্তাহে এই দুইদিন রোজা রাখতেন। নবীর মসজিদে খেজুর আর জমজমের বরকতময় (মক্কার জমজম মদিনায় নবীর মসজিদেও সরবরাহ করা হয়) পানিতে ইফতার সম্পন্ন করে মনে হলো লাখো মুসলমানের প্রেমময় মহাসমুদ্রে ভাসছি। শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) সারাদিনও অন্যান্য দিনের অনেক বেশি জিয়ারতকারীর উপস্থিতি ঘটে। হজরত আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিস এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ''তোমরা জুমআর (শুক্রবার) দিন বেশি বেশি করে দরূদ পড়ো। নিশ্চয়ই ফেরেস্তারা এর উপর সাক্ষী থাকে। আর যখন কেউ আমার উপর দুরূদ পড়ে তখনই তা আমার নিকট পেশ করা হয়। '' আবু দারদা (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) বলেন, ''আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মৃত্যুর পরেও কি তা পেশ করা হবে? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ!, কেননা আল্লাহ তায়ালা জমিনের জন্য নবীদের দেহ ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন।
হজরত আওস ইবনে আওস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ''রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিনটি হচ্ছে জুমু’আর দিন। অতএব তোমরা ওইদিন আমার ওপর বেশি বেশি করে দরূদ পড়ো। কারণ তোমাদের দরূদগুলো আমার নিকট পেশ করা হয়। সাহাবা কিরাম আরয করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের দরূদ কীভাবে আপনার নিকট পেশ করা হবে, আপনি তো তখন জমিনের সঙ্গে মিশে যাবেন? তিনি বললেন, “নিশ্চিত নবীগণের দেহকে আল্লাহ জমিনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। ”
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার কবরের পাশে গিয়ে দরূদ পাঠ করে তা আমি নিজেই শুনবো। আর যে ব্যক্তি দূর থেকে আমার উপর দরূদ পাঠ করে তা আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ''
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমার কবরকে আনন্দ-উৎসবের স্থানে পরিণত করো না, বরং আমার ওপর দরূদ পড়ো। কারণ তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ''তোমাদের যে কেউ আমার উপর সালাম পড়ে, আল্লাহ তখনই আমার রূহ আমাকে ফেরত দেন এবং আমি তার সালামের জবাব দেই। ''
হজরত আমের ইবনে রবীআহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ''আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খুতবার মধ্যে বলতে শুনেছি, আমার উপর দরূদ পাঠকারী যতক্ষণ দরূদ পড়ে, ফেরেশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে। ''
হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা আমার নিকটবর্তী হবে, যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি দরূদ পাঠ করেছে"।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ''যে আমার উপর একবার দরূদ পড়বে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন, তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করা হবে এবং দশটি দরজা বুলন্দ হবে। ''
হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব (রহ.) ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ''রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দোয়া আসমান ও জমিনের মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, তোমাদের নবীর উপর দোয়া ও দরূদ পড়া ছাড়া কোনো দোয়াই আসমান পর্যন্ত আরোহন করে না''।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ''নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ''যতক্ষণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়া হবে না ততক্ষণ দোয়া কবুল করা হয় না''।
হজরত উম্মে দারদা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ''যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় দশবার করে দরূদ শরিফ পাঠ করে, সে কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করবে''।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ''যখন তোমরা মুআয্যিনের আজান শুনবে তখন তার মত বলো। তারপর আমার উপর দরূদ পড়ো। কেননা যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পড়বে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর দশবার দরূদ পাঠ করবেন। তারপর তোমরা আল্লাহর কাছে আমার জন্য উসিলার দোয়া করবে। কারণ উসিলা হলো জান্নাতে একটি উচ্চতর মর্যাদা, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে শুধু একজনই প্রাপ্ত হবে। আমি আশা করি আমিই হবো সেই ব্যক্তি। অতএব যে ব্যক্তি আমার জন্য আল্লাহর কাছে উসিলার দোয়া করবে সে আমার সুপারিশ প্রাপ্ত হবে''।
হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তির সামনে আমার নাম আলোচিত হয়েছে অথচ সে আমার ওপর দরূদ পড়েনি সে হচ্ছে প্রকৃত কৃপণ। ” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ''যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পড়া ভুলে যাবে সে জান্নাতের রাস্তা ভুলে যাবে। "
মহা মানবতার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আমাদের সালাম ও দরূদ জানাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৭
এমপি/আইএ