বইটির নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন’। লেখক নুরুল ইসলাম মানিক।
আলোচিত বইটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যা, বিকৃত ও বিভ্রান্তিমূলক অনেক তথ্যে ভরা। যদিও বাংলাদেশ সরকারের আইনে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যারা মিথ্যা তথ্য, বিকৃত তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়াবে তাদের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ফাঁক গলে প্রকাশ হলো এমন বই।
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন’ বইয়ের শুরুতে মহাপরিচালকের কথায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। এ প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত ও সমাদৃত। কাজেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশের ইচ্ছে আমার বহুদিনের। বিষয়টি নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক বিশিষ্ট লেখক ও গীতিকার জনাব নুরুল ইসলাম মানিকের সাথে আমার এই অভিপ্রায়ের কথা জানালে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জমা দেন। মহান বিজয়ের মাসে বইটি শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিতে পেরে আল্লাহর (বানান ভুল, লেখা অল্লাহর) দরবারে অশেষ শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি। ’
মহাপরিচালকের ভূমিকায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে বইটি লেখা হয়েছে। বাংলানিউজের হাতে আসা বইয়ের প্রিন্ট সাইজ, অঙ্গসজ্জাও তাই বলে। কিন্তু বইয়ে দেওয়া বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এমন অসত্য ও বিকৃত তথ্য সম্বলিত বই থেকে শিশু-কিশোররা কী শিখবে? যেখানে বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান থেকে এমন বিকৃত ইতিহাস সম্বলিত বই প্রকাশ কীভাবে হলো- তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক দায়িত্বশীল পরিচালক, গভর্নর বাংলানিউজের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এ বই নিয়ে।
তাদের দাবি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি হিসেবে নিয়োগ পান সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এ পদে যোগদানের পর থেকে দীর্ঘ নয় বছর তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। নানা কারণে বিতর্কিত তিনি। আগামীতে তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তিনি জোর তদবির করছেন। আর এ জন্য তিনি তড়িঘড়ি করে এমন একটি বই লিখিয়ে সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
জানা যায়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন’ বইটি দেড় লাখ কপি ছাপা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভাগীয় অফিস থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বইগুলো পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। তবে বই বিতরণ ও বিতরণ করা বই প্রত্যাহার এবং কীভাবে এমন বই প্রকাশ পেলো তা জানতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি উঠেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কেউ মুখ খুলছেন না।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বইয়ের- ৮, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ৩৪, ৩৮, ৪১, ৪৪, ৪৫, ৪৮, ৪৯, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে জাতির জনক ও তার পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ভুল, বিকৃত ও মারাত্মক অসত্য তথ্য।
যেমন, বইয়ের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘… এমতাবস্থায় ১৯৩৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হলো পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। ৩১ জানুয়ারি এ দলের নেতৃত্বে বাংলাভাষায় দাবিতে গঠন করা হলো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ৯ জুলাই বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচিত করা হলো দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল থেকে ১৩ বছর এ দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালের ৯ জুন তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। ১৯৫৫ সালের আগস্টে দলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ’ ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ’
এই অংশের লাইনে লাইনে অসংলগ্ন, অসত্য, ভুল, বিকৃত ও মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিও জানেন আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। আর ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল (মহাসচিব) নির্বাচিত হন। অথচ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৬৬ সাল থেকে ১৩ বছর এ দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ’ বইয়ের দেওয়া তথ্যমতে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরণ করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
বইটিতে অসংখ্য বানান ভুলের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়ের সালও ভুল লেখা হয়েছে (লেখা হয়েছে ১৯৬৮, হবে ১৯৬৭)।
এভাবে বইয়ে মুজিবনগর সরকার, জাতীয় শিশু দিবসের সূচনা, শেখ রেহানার জন্মস্থান, শেখ কামালের জন্ম তারিখ, বঙ্গবন্ধুর কারাবরণ ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার বইয়ে রয়েছে অসংখ্য ভুল।
অনেকের ধারণা, ইচ্ছেকৃতভাবেই এ ধরনের ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হেয় করা হচ্ছে। তা না হলে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বইয়ে এ ধরনের ভুল থাকতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সামীম মোহাম্মদ আফজাল জুডিশিয়াল সার্ভিসে ১৯৮৩ সালে যোগ দেন। সর্বপ্রথম সিলেটে সহকারী জজ হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। পরে আইন কর্মকর্তা, সাব জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ), বিচারক (নারী ও শিশু), বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় জ্যুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক লবিংয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগ দিয়ে নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। এসব আড়াল করতেই তিনি এমন একটি বই রচনা করিয়েছেন। এক্ষেত্রে যথাযথ কার্যাদেশ ও নিয়মনীতি রক্ষা করা হয়নি। তাই বইটিতে এমন ভুল রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ফোনে সামীম মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করে কেটে দেন।
পরে বইটির প্রকাশক ড. মুহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, ডিজি মহোদয়ের নির্দেশে, ইচ্ছায় বইটি ছাপা হয়েছে। ছাপার আগে পাণ্ডুলিপিও আমি দেখিনি। আমাদের সেভাবে দেখানো হয় না। ক্রেডিট লাইনে নাম দেওয়া হয়। তবে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হিসেবে তো দায়িত্ব এড়াতে পারি না। ভুলগুলো ঠিক করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭
এএ