বললেন, আমার ধারণা হলো- এই শিশুটির মা হয়তো আমাদের জামাতে শরীক হয়েছে। (নামাজ দীর্ঘ হলে শিশুর কান্নাও থামবে না আর তার মা নামাজে মন বসাতে পারবে না) এই ছিল আমাদের প্রাণপ্রিয় নবীজির মানবিক অনুভূতি।
আল্লাহর ইবাদত মানুষকে অস্বীকার করে নয়। আধ্যাত্মিক সাধনা নারী শিশু সমাজ ও প্রতিবেশকে না দেখে নয়। এক গ্রাম্য ব্যক্তি মদিনা শরীফে এসে মসজিদে নববীর এরিয়ায় পেশাব করতে বসে পড়লো। উপস্থিত সাহাবিরা সশব্দে তাকে নিবৃত করতে ছুটলেন। নবীজি (সা.) তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লোকটি যখন না বুঝে বসেই পড়েছে তখন তাকে শান্তিতে তার কাজটি সারতে দাও। পরে বুঝিয়ে বলো যেন সে ভবিষ্যতে আর এমন না করে। ’
নবী করিম (সা.) লোকটিকে বিব্রত করা কষ্ট দেওয়া বা লজ্জায় ফেলে দেওয়া পছন্দ করেননি। এই ছিল মহানবী (সা.)-এর আখলাক ও আচরণ। হাজার ঘটনা এমন আছে।
ইসলামে এমন বিধান রয়েছে, নামাজের জামাতে ইমাম সাহেব সবচেয়ে বয়স্ক ও দুর্বল ব্যক্তিটির প্রতি লক্ষ্য করে নামাজ আদায় করবেন। ইসলামে জোরে মাইক লাগিয়ে কোরআন শরিফ শবিনা পড়া আলেমরা সমর্থন করেন না। কারণ, কোরআন পড়ার সময় নীরবে মন লাগিয়ে তা শোনা শ্রোতাদের ওপর ওয়াজিব। নির্দিষ্ট জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে সমবেত মুসলমান ছাড়া দুনিয়ার নানা কাজে ব্যস্ত মুসলিমদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তাছাড়া সারারাত উচ্চশব্দে কোরআন পাঠ করলে তা কোনো রুগী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, বৈধ যৌনসম্পর্কে লিপ্ত, বিষণ্ণ, নিদ্রামগ্ন, বৃদ্ধ, শিশু বা পাপকার্যে লিপ্ত মানুষের জন্য ‘বিরক্তি বা বিব্রতকর’ হওয়া অসম্ভব নয়। ফলে তারা কেউ যদি কোরআনের বিরুদ্ধে কোনো অসতর্ক উক্তি করে বসে তাহলে তাদের যেমন গোনাহ হবে, ক্ষেত্রবিশেষ ইমানও নষ্ট হতে পারে। এমনিভাবে শরীয়ত বিরোধী এমন উপস্থাপনার জন্য এর উদ্যোক্তারাও গোনাহের ভাগি হবেন।
স্বয়ং কোরআনের ক্ষেত্রেই যদি শব্দ নিয়ন্ত্রণের মাসআলা থাকে তাহলে ওয়াজ ও জিকিরের জন্য থাকবে না কেন? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘মনে মনে তুমি আল্লাহর জিকির করো, গোপনে ও ভীতকম্পিত হয়ে, উচ্চকণ্ঠে নয়। ’
হজরত আবু বকর (রা.) বলতেন, তাহাজ্জুদে কোরআন তেলাওয়াত খুব নিম্নস্বরে করো। যাতে অন্য কারও ঘুম না ভাঙ্গে। হজরত ওমর (রা.) বলতেন, আমি চাই তেলাওয়াত হালকা উচ্চস্বরে হোক। যাতে নিদ্রিত ব্যক্তির ঘুম না ভাঙ্গে কিন্তু কিছুটা সজাগ ব্যক্তি পূর্ণ জাগ্রত হয়ে যায়। যেন, তার পক্ষে কিছু নামাজ ও তেলাওয়াত করা সম্ভব হয়। এই ছিল মহান খলিফাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
মাইক বা শব্দযন্ত্র আবিষ্কারের আগে মানুষ আজান, নামাজ, ওয়াজ-জিকির ইত্যাদি নিজের কণ্ঠ ব্যবহার করেই করতো। বর্তমানে মাইক ছাড়া এর কোনোটাই চলে না। মোবাইল নিয়েও একই কথা। দেশে বিদেশে বহু আলেম এখন মোবাইল ব্যবহারের মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে কিতাব লিখছেন। বাংলাদেশেও বহু বই লেখা হয়েছে। মাইকের ব্যবহার নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা হয়ে থাকে। তারপরও বহুলোক এলেম না থাকার কারণে মাইক ব্যবহারের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশনা পালন করতে পারে না।
যেখানে অল্প মানুষ, তারা সেখানেও বেশি মানুষের সমান শব্দ তৈরি করে। যে আলোচনা মসজিদ বা হলরুমে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত, তা দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত ও অমনোযোগী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য খামাখাই পাড়ায়, মহল্লায় মার্কেট ও রাজপথে লাউডস্পিকার দিয়ে বিকট শব্দের সৃষ্টি করে। যার একটি কথাও কেউ কোথাও বসে মনোযোগ দিয়ে শুনে কি-না সন্দেহ। তবে হাজারও মানুষ শব্দদূষণের শিকার হয়। ধর্মীয় বিষয় বলে কেউ কিছু বলে না। মনে করে এটাই নিয়ম। কিছু বললে গোনাহ হয় কি না! তাছাড়া সামাজিকভাবেও নিগৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ ইসলাম এসব সমর্থন করে না।
মানুষের কষ্ট হয় এমন কোনো আয়োজন ইসলামি শরীয়ত কোনোদিন সমর্থন করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত ও শরীয়তের জনকল্যাণমূলক নীতি এসব বিষয়ে পরিমিতি সংযম ও শান্তির পক্ষে। একজন হৃদরোগীর কষ্ট বিবেচনা করে, কয়েকজন পরীক্ষার্থীর অসুবিধা বিবেচনা করে মাইক বন্ধ রাখা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে।
যেখানে কোরআন তেলাওয়াতরত ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়া, জরুরি আলোচনায়রত মানুষদের সালাম না দেওয়া, খানা খাওয়া অবস্থায় কাউকে সালাম না দেওয়া, গভীর চিন্তামগ্ন মানুষকে সালাম না দেওয়া, জিকির বা অজিফা পাঠরত মানুষকে সালাম না দেওয়া, জুমার দিনে নামাজ ও খুতবা চলাকালে মুসল্লিদের সালাম না দেওয়া শরীয়তের বিধান। সেখানে ব্যক্তিগত হাজারও কাজে নিমগ্ন মানুষের কানের কাছে ১০টি ২০টি মাইক বেঁধে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওয়াজ শুনতে বাধ্য করা কতটুকু যৌক্তিক তা উদ্যোক্তাদের ভেবে দেখতে হবে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাহফিল হয় দিনব্যাপী। এতে মানুষের ঘুম নষ্ট হয় না। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের পথিকৃৎ আলেম মাওলানা আহমাদ আলী খান (রহ.) রাত ১১টার পর কোনো মাহফিল সমর্থন করতেন না। বলতেন, এতো সব মানুষের কষ্ট হ, আর ফজর কাজা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (রহ.) নিয়ম জারি করে গেছেন, তার অঞ্চলে ১২টার পর কোনো মাহফিল থাকে না। অথচ দেশব্যাপী এখন দুপুর থেকে সারারাতব্যাপী এমনকি পরদিন বেলা ৮টা পর্যন্ত একটানা সারা এলাকা মাইকের আওয়াজে গমগম করে। কেউ কষ্ট পাচ্ছে কি না তা ভেবে দেখারও যেন কারও সময় বা সাহস নেই।
দেশের শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই আমার সঙ্গে এপ্রসঙ্গে কথা বলার সময় ‘সারারাত মাহফিল’ ও ‘অতিরিক্ত মাইক’ নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মসজিদ, হেফজখানা, মাদরাসা, স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা বিবেচনা না করে গায়ের জোরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, বিভিন্ন দিবস পালন করা এদেশে রেওয়াজ আছে বটে তবে ধর্মের ব্যাপারে যেন এমন অসাবধানতা কেউ না করতে পারে, এ ব্যাপারে সমাজের সচেতন ব্যক্তি, উলামায়ে কেরাম, ইমাম-খতিব সাহেবান সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।
কিছু লোক বিয়েশাদী, মুসলমানি, গায়ে হলুদ, জন্মদিন ইত্যাদিতে উচ্চশব্দে গানবাজনা করে মানুষকে যেভাবে কষ্ট দিচ্ছে- তা একটি সভ্য সমাজে চলে না। কিন্তু এদেশের ‘জনঅশান্তি’ বিষয়টি খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এসব মানসিক অত্যাচার জনগণকে সহ্য করতে হচ্ছে।
আসলে সমাজের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানা পাপাচারে আমাদের উপলব্ধি ও মনুষ্যত্ব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। যা আল্লাহর একটি বড় গজব।
কিছু নাস্তিক-মুরতাদ ও ছদ্মবেশী বেঈমান বুদ্ধিজীবী এসব নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিন মিন সুরে ইসলামবিরোধী কথা বলার সুযোগ নেয়। তারা বলে, মাইকে আজান বন্ধ করা হোক। ওয়াজ মাহফিল যেন এতো বেশি না হয়। আমাদের বুঝতে হবে, যদি ইসলামের পাবলিক অধিকার আমরা না দেই। যদি আমরা নাগরিকদের শান্তির দিকে খেয়াল না রেখে ধর্মের নামে যাচ্ছেতাই করে বেড়াই। যদি বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ না শুনে এলেমহীন লোকজন গায়ের জোরে মসজিদ-মাদরাসা-খানকা ও মাহফিল চালায়। তাহলে দুশমনরা তাদের শয়তানি দাবীর পক্ষে কিছু হলেও জনসমর্থন পেয়ে যাবে। যারা জাহেল উদ্যোক্তাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির ফলে বিরক্ত তারা ওইসব ইসলাম বিদ্বেষীর কথায় সমর্থন দেবে।
একটি মসজিদ যতদূর এলাকার মুসল্লিকে কভার করে, এরচেয়ে দূরে এই মসজিদের মাইকের আওয়াজ পৌঁছানো কতটুকু জরুরি তা মসজিদ কমিটিকে ভাবতে হবে। মিনার বা ছাদে কিংবা পাশের ভবনে মসজিদ কমিটি যখন লাউডস্পিকার লাগান, তখন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, এ যন্ত্রটির সবচেয়ে কাছে যে ঘর বা বাড়িটি তাদের কাছে এর শব্দটি কতটুকু সহনীয়। দূরে যা সুমধুর খুব কাছে তা কষ্টদায়কও হতে পারে। বিশেষ করে নবজাতক, ছোট্টশিশু, বৃদ্ধ, হৃদরোগী, অন্যান্য রোগী, শ্রমক্লান্ত মানুষ বা ইবাদতরত ব্যক্তি এ আওয়াজটি কিভাবে নিচ্ছে। সারা শহরের বা দূর পল্লীর সব মসজিদ যদি নিজ প্রয়োজন পরিমাণ আওয়াজে দ্বীনি কাজ সারে। যদি ওয়াজ মাহফিলগুলো দুনিয়াবি অন্যান্য প্রোগ্রামের সঙ্গে পাল্লা না দিয়ে নিজের নীতি নিয়ম মেনে সংযত উপায়ে মাইকের ব্যবহার করে, তাহলে এসবের রহমত-বরকত ও ফলাফল আশানুরূপ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শরীয়তে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। ’ শরীয়ত যে নির্দেশ চাপিয়ে দেয়নি, নিজ সিদ্ধান্তে এমন কঠোর পরিবেশ তৈরি করা শরীয়তে পরিষ্কার নিষিদ্ধ। যে জন্য হজরত ওমর (রা.) একবার এক ব্যক্তিকে এজন্য শাস্তি দিয়েছিলেন যে, লোকটি নামাজের পর মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘কিছু খেজুর পাওয়া গেছে, যার হয় নিয়ে যাবেন। ’ সাজা দেওয়ার সময় বলেছিলেন, মদিনায় কি এখন দুর্ভিক্ষ চলছে যে, কয়েকটি খেজুরের জন্য গোটা মসজিদের মুসল্লিদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে? এটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো? এমন ফালতু একটি কাজের জন্য সব মুসল্লিকে বিরক্ত করায় তোমাকে এই শাস্তি দিলাম। ’
পাঠক ভেবে দেখুন, আমাদের দেশে নামাজে আসা মানুষকে কতকিছু বলেই না মসজিদে বিরক্ত করা হয়। নেহায়েত অশিক্ষিত ও অযোগ্য লোকজন ধর্মীয় প্রয়োজন ছাড়া নানা বাজে কথা মসজিদে দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলতে থাকে। আর আল্লাহর ইবাদতের জন্য মন তৈরি করে মসজিদে আসা মানুষ কষ্ট করে এসব শুনতে বাধ্য হন।
শরীয়তে বিধান আছে, মসজিদের বাইরে সংঘটিত কোনো বিষয়ের ঘোষণা মসজিদে করা যাবে না। কিন্তু এখন দেখা যায়, দুনিয়ার সব ছোট-বড়, মরা-বাঁচা, ভালো-মন্দের ঘোষণা নির্দ্বিধায় মসজিদে বসে করা হচ্ছে। শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া যখন তখন মসজিদের মাইক ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক মুরতাদরা সুযোগ বুঝে এ নিয়ে উল্টাপাল্টা কথাও বলছে।
আল্লাহর রহমতে নামাজি বৃদ্ধি পাওয়া ও মসজিদের দ্রুত বিকাশ একটি ইতিবাচক বাস্তবতা। তবে এসবের মাসআলা-মাসায়েল সুন্নত ও আদব শিক্ষা সেই গতিতে হচ্ছে না। আমরা বাস্তবতা তুলে ধরে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আবেদন করছি, দ্বীনি বিষয়েও শরীয়তের নির্দেশনা না জেনে কেউ কোনো কাজ করবেন না। জেনে নিন, আপনার এই নেক কাজটির ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম কি বলে। কোরআন-সুন্নাহ কি বলে।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২১১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৮
এমএইউ/