সোমবার (০২ এপ্রিল) ভোরে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় কুনদুজ প্রদেশের দাশতি আচিন জেলায় হাশেমিয়া মাদরাসায় এই হামলা চালানো হয়। কোনো কোনো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ নিহতের সংখ্যা ৭০ জন উল্লেখ করলেও স্থানীয়দের দাবি, সেখানে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।
খবরে বলা হয়, হামলার সময় মাদরাসাটিতে হিফজ সমাপনকারী ছাত্রদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠান চলছিল। নাম গোপন রাখার শর্তে ওই জেলার একজন কর্মকর্তা বলেন, বোমা হামলায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে তালেবানের প্রথম সারির কয়েকজন কমান্ডার রয়েছে।
এদিকে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রাদমানিশ বলেছেন, তালেবানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের টার্গেট করে এই হামলা চালানো হয়। এতে ৩০ জনেরও বেশি তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়েছে। হামলায় কোনো বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়নি বলেও জানান তিনি।
তবে তালেবান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, হামলায় তাদের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। এসময় তাদের কোনো যোদ্ধা সেখানে উপস্থিত ছিল না।
আল জাজিরা স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, বোমা হামলায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। স্থানীয় অধিবাসী মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, হামলার সময় মাদরাসাটিতে বিপুল সংখ্যক শিশু শিক্ষার্থী ছিল। সফলভাবে ধর্মীয় শিক্ষার কোর্স সম্পন্ন করার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান চলছিল।
আফগানিস্তানে নিয়োজিত জাতিসংঘের মিশন ইউএনএমএ বলেছে, একটি মানবাধিকার সংগঠন সোমবারের হামলার ঘটনাটি তদন্ত করবে। টুইটার বার্তায় সংস্থাটি জানিয়েছে, ‘হামলায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়টি ইউএনএমএ তদন্ত করে দেখবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নিয়োজিত মানবাধিকার সংগঠন প্রকৃত সত্য উদঘাটন করবে। ’
গত ২ এপ্রিল বিমান হামলার ঘটনাটি ঘটে। এর পর থেকেই এ ঘটনার রেশ ছড়িয়ে আছে অনলাইন জগতে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা হামলায় নিহত খুদে হাফেজদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। তাদের মন খারাপ ও বেদনার কথা ব্যক্ত করছেন সামাজিক মাধ্যমে।
এএফপি ও রয়টার্সের ছবিতে দেখা গেছে, আহত শিশুদের চিকিৎসা নিতে। এ সময় হাসপাতালের বাইরে সন্তানহারা মায়েদের আর্তনাদ করতে দেখা গেছে। তাদের আশপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সবাই কাঁদছিলেন।
সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে আমাদের বাড়িঘর, হাসপাতাল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা সব ধরনের নীতি-নৈতিকতার বিরোধী।
২০১৫ সালের অক্টোবরে একই জেলায় ডক্টরস উইদাউট বর্ডাসের হাসপাতালে চালানো বিমান হামলায় চিকিৎসক ও রোগীসহ অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছিলেন।
সোমবার চালানো হামলার স্থান, হতাহতের সংখ্যা ও উপলক্ষ্য নিয়ে গণমাধ্যমে নানারকম বক্তব্য এসেছে। সবকিছু ছাপিয়ে সাইবার জগতে শিশুদের আহত ও নিহত হওয়ার ছবিগুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক ও পীড়াদায়ক।
মানুষকে মানুষ বলা হয় কারণ তার মধ্যে মানবিকতা আছে, বোধ-বিবেক রয়েছে। মানুষের রয়েছে হিতাহিত জ্ঞান ও ভালো-মন্দ যাচাই করার সক্ষমতা, যা অন্য কোনো জীবের মাঝে অনুপস্থিত।
মানুষের বোধশক্তি আছে বলেই তারা দুঃখ পেলে কাঁদে, আনন্দিত হলে হাসে। সেই বোধ থেকেই বিশ্বের নানা প্রান্তের রক্তাক্ত মুখগুলো মনুষ্য বিবেককে কাঁদায়। মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়। দাবি ওঠায় মানবাধিকার রক্ষার। যদিও বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ডামাডোলে মানবাধিকার বিষয়টি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
আমরা জানি, মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একইসঙ্গে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হলো- এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা। মানবাধিকার বলতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারকে বোঝায়। মানবাধিকারের সঙ্গে বিশেষ কোনো ধর্ম ও জাতির সম্পৃক্ততা নেই। তদ্রুপ অপরাধের ক্ষেত্রে সব ধর্মের ও সম্প্রদায়ের লোকেরা সমান অপরাধী এটা বিবেচিত হওয়া উচিত।
আমরা মনে করি, প্রত্যেকটি হামলা ও হত্যা অবশ্যই অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠাকে সাধুবাদ জানাই। পৃথিবীতে যত ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে, তার মধ্যে কোনো ধর্ম মানুষ হত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। এর পরও দেশে দেশে হানাহানি হচ্ছে, তবে কী বলতে হবে- সত্যিকারের ধর্মীয় শিক্ষা, মানবতা ও বিবেকবোধ সমাজ থেকে লোপ পেয়েছে? না হলে জাত-ধর্ম ও সম্প্রদায় ভুলে রক্তের লাল রঙ দেখে মানুষের বিবেকবোধ কেন জাগ্রত হয় না?
অথচ পৃথিবীর সব মানুষের কান্নার শব্দ এক। স্বজন হারানোর বেদনা সবার এক। জাতি, ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে সবার রক্তের রঙও এক। তাহলে মানুষে মানুষে কেন এ হানাহানি? মানবাধিকারের বিষয়ে কেন এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি? এর কী কোনো জবাব আছে?
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৮
এমএইউ/