বিস্তীর্ণ পৃথিবীজুড়ে মানবজাতির পিতা আদম (আ.) ও মা হাওয়া আবাসভূমি ছিল। বিশাল পৃথিবীর বুকে তখন কেউ কোনো সীমানা চিহ্ন আঁকতে পারেনি।
সীমানা চিহ্ন দিয়ে নিজেদের আবাস ভূমি বিভক্ত করে ফেলে। অবাধ স্বাধীনতার ভূমি সংকুচিত করে ফেলে। ফলে পৃথিবীতে ছোট-বড় অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন জাতি-গোষ্ঠির জন্ম হয়।
কোনো জাতির নির্দিষ্ট অংশ যখন অন্য অংশের দ্বারা অথবা অন্য কারো মাধ্যমে নির্যাতিত হয়। নিজেদের স্বাধীনতা-অধিকার হারাতে বসে এবং বঞ্চিত ও শোষিত হয়, তখন নিপীড়িত ও শোষিত জনগোষ্ঠী শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে যুদ্ধ-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ঠিক একই কারণে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শোষকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আপামর জনতা জেগে ওঠেছিল। শেষ পর্যন্ত সাড়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ও স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয় হয়েছিল।
স্বদেশপ্রেম ও জাতি-প্রীতি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস। বিশেষত মুসলমানদের রক্তের শোণিতধারায় দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা অত্যাবশক। কারণ মহানবী (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ও আদর্শ।
হাদিসে এসেছে, যখন রাসুল (সা.)-কে অত্যাচারী কাফেরদের কারণে মক্কা ছেড়ে আসছিলেন, তখন তিনি মক্কার দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে ছিলেন আর বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমার এখান থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি খুব ভালো করেই জানি, তুমি আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও সম্মানিত। তোমার লোকেরা আমাকে যদি তোমার থেকে বের করে না দিতো, তাহলে আমি কখনো তোমার থেকে বিদায় নিতাম না। ’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস নং : ২৬৩৫)
মহানবী (সা.) কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ও হুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজির চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, ‘এই ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ১০২৮)
দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করা। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে, তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে। ’ (মুসলিম, হাদিস নং :১৯১৩)
বাস্তবপক্ষে প্রত্যেক বিজয় জাতিরই রয়েছে, মুসলমানেরও আছে। কিন্তু মুসলমানের বিজয় নানা দিক থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র্য। চিন্তা-আদর্শ, মূল্যায়ন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপন্থাসহ সব দিক থেকেই ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন রকমের।
কোরআনে বিজয়ের দু’টি রূপ খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এক. স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ। দুই. কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ।
প্রথমটিতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘রাজা-বাদশা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান-লোকদের অপদস্থ করে। ’ (সুরা নামল, আয়াত : ৩৪)
এ ধরনের যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় যত দেশে হয়েছে, সেখানে কত জনপদ তছনছ হয়েছে, কত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বিনিময়ে মানবতা শাসক-প্রভুর বদল ও শোষনের পালাবদল ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এ কারণে বিজয়ের এ প্রকারটি মানবতার বিজয় নয়, বরং নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বিজয়।
বিজয়ের আরেক রূপের ব্যাপারে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি এদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত আদায় করবে, জাকাত দান করবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন। (সুরা হজ, আয়াত : ২২)
এ ধরনের বিজয় হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয়। মানব, মানবতা ও সততার বিজয়।
মুসলিম হিসেবে আমাদের বিজয়ের গৌরববোধ থাকা উচিত। আর বিজয়ের দ্বিতীয় রূপটিই আমাদের আদর্শ ও মননে। শুধু নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তব ইতিহাসেও এ রূপটিই আমাদের বিজয়ের রূপ। তবে হাজার বছরের পথচলায় কখনো কখনো বিচ্যুতি ঘটেছে।
ইসলামধর্মে বিজয় দিবস উদযাপনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এ দিনের অন্যতম করণীয় হলো—আট রাকাত নফল নামাজ পড়া। কারণ নবী (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন শুকরিয়াস্বরূপ আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেছিলেন। (জাদুল মাআদ, ২য় খণ্ড)
বিজয়ীদের করণীয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করো। আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। ’ (সুরা : নাসর, আয়াত : ১-৩)
এ আয়াত থেকে জানা যায়, বিজয় দিবসের দিন আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে—
আল্লাহর বড়ত্ব ও পবিত্রতার বর্ণনা করা। যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের অজান্তে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া।
পূর্বে উল্লেখিত আয়াতের মাধ্যমে জানা যায়, বিজয়ীদের উচিত নামাজ আদায় করা, জাকাত দান করা এবং সৎকাজে আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজে নিষেধ করা।
এছাড়াও হাদিস থেকে জানা যায়, আট রাকাত নামাজ আদায় করা। মৃত ব্যক্তিদের জন্য ইস্তেগফার ও দোয়া করা। কোরআন পাঠসহ বিভিন্নভাবে ইসালে সওয়াব করা।
মুসলমানদের উচিত, ইসলামী সংস্কৃতি অনুসরণ করে মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করা ও বিজয় উদযাপন করা।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮
এমএমইউ/এসএইচ