মূলত প্রশাসন বলতে মানুষের অভিযোগ প্রদান ও সমস্যা সমাধানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবিশেষকেও বোঝানো হয়। আবার প্রশাসন সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের হতে পারে।
প্রশাসন সবসময় অন্যের কল্যাণে কাজ করে থাকে। কারণ অন্যায়-অবিচার রোধ করা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের জরুরি কর্তব্য। অন্যথায় সমাজব্যবস্থায় শৃঙ্খলা টিকে থাকে না। এবং এক্ষেত্রে প্রশাসনকে নিজস্ব নীতিমালায় অটল থাকা অপরিহার্য। অপ্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকাও আবশ্যক। এতে লোকজন প্রশাসন থেকে এবং প্রশাসন তাদের থেকে উপকৃত হওয়া সহজতর হয়ে ওঠে।
অনেক সময় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের কাছে ‘অপরিণামদর্শী ও অসৎ’ ব্যক্তিরা পৌঁছে যায়। ফলে প্রশাসনের বদনাম হলেও দায়িত্বশীলদের চোখে পর্দা দিয়ে এবং মুখে চুনকালি মাখিয়ে তারা ‘অসুন্দর’ এর মহোৎসবে মেতে ওঠে।
তাই প্রশাসন আপন নীতি-আদর্শে অটুটু থাকার পাশাপাশি সততা ও নিষ্ঠাবিধৌত নিয়ম-রীতি পরিচালনা অব্যাহত রাখলে, প্রশাসনে কোনো অপশক্তির অনুপ্রবেশ গতে পারে না। উপরন্তু যদি কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা উপহার দেওয়া যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ ও অধীনস্থরা সহজে ন্যায্য অধিকার লাভ করতে পারে এবং সবদিক থেকে সুরক্ষার পায়। পারস্পরিক বিবাদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিপরিতে সহনশীলতা ও হৃদ্যতা তৈরি হয়।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ রেখে গেছেন। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে আছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি ইসলামের বিধি-বিধানকে এমনভাবে অনুসরণ করেছেন যে, তার সময়কালে বাঘ ও ছাগল একসঙ্গে মাঠে বিচরণ করা করতো। অথচ বাঘের সঙ্গে ছাগলের ‘দা-কুমড়া সম্পর্ক’।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানেও যদি প্রশাসনে ইসলামি বিধি-বিধানের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়, তাহলে যেকোনো ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮)
আরো বলা হয়েছে, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট। হে মানুষ! তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের অপসারিত করতে এবং অপরকে আনতে পারেন, আল্লাহ এটা করতে পুরোপুরি সক্ষম। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩২-১৩৩)
নিরপেক্ষভাবে অধীনস্থের অধিকার আদায়ে কাজ করা প্রশাসনের মৌলিক কাজ। কোনো ধরনের ভেজালযুক্ত কাজ অগ্রহণযোগ্য। যারা ন্যায় ও সততার সঙ্গে ‘ক্ষমতা ও পদের’ ব্যবহার করেন, আখেরাতে তাদের মহা পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) হাদিসে বলেন, ‘ন্যায়-নীতিবান বিচারক কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার ডান পাশে দ্যূতিময় মিম্বারের ওপর অবস্থান করবে। অবশ্য আল্লাহ তাআলার উভয় পাশই ডান। তারাই সেসব বিচারক বা শাসক, যারা নিজেদের বিচার-বিধানে, নিজেদের পরিবার-পরিজনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ৪৮২৫)
অন্য হাদিসে গুরুত্ব দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর (কেয়ামত দিবসে) তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরসংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোলাম তার মনিবের মালসম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই (কেয়ামত দিবসে) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (বুখারি, হাদিস নং : ২৫৫৪; মুসলিম, হাদিস নং : ৪৮২৮)
অতএব গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পর প্রত্যেক মুমিনের উচিত প্রশাসনিক শক্তির যেন অপব্যবহার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। যারা ইচ্ছাপূর্বক অপব্যবহার করবে, তাদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। পৃথিবীতেও আসতে পারে যেকোনো বিপদাপদ। অসৎপন্থা অবলম্বন করে অন্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা, ধোঁকাবাজির কারণেই তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম জনগণের শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে প্রতারক বা আত্মসাৎকারীরূপে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। ’ (বোখারি, হাদিদস নং : ৭২৩৯; মুসলিম, হাদিস নং : ৩৮০)
অন্য হাদিসে বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ ‘জাতি’র দায়িত্ব অর্পণ করেন; কিন্তু সে তাদের কল্যাণকর নিরাপত্তা বিধান করল না, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। ’ (মেশকাত, হাদিস নং : ৩৫১৮)
তাই অধীনস্থের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করা ও তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া প্রশাসকের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ সহনশীলতা ও সহানুভূতি প্রকাশ মানবাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘লোকদের সঙ্গে সহজ-সরল ব্যবহার করো, কষ্টদায়ক ব্যবহার করো না। তাদের সান্ত্বনা প্রদান করো, বীতশ্রদ্ধ করো না। ’ (বোখারি, হাদিস নং : ৬১৯৩; মুসলিম, হাদিস নং : ৪৬২৬)
অন্য হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখনই তার কোনো সাহাবিকে কোনো কাজে পাঠাতেন, তখন তাকে এভাবে উপদেশ দিতেন, ‘তোমরা লোকদের আশার বাণী শোনাবে, নৈরাশ্যজনক কথা বলে তাদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলবে না। তাদের সঙ্গে উদার আচরণ করবে, কঠোর ব্যবহার করবে না। ’ (বোখারি, হাদিস নং : ৬৯; মুসলিম, হাদিস নং : ৪৬২২)
ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৯
এমএমইউ/